[কানাডীয় লেখিকা মার্গারেট আটউডের সাথে পাঠকের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস নেহাতই অনাবশ্যক। ১৯৩৯ সালে জন্মানো এই অতি জনপ্রিয় লেখিকার গ্রন্থপঞ্জীতে ইতিমধ্যেই আঠেরোটিরও বেশী কবিতা সঙ্কলন, আঠেরোটি উপন্যাস, এগারোটি গদ্য এবং নটি ছোটগল্পের সঙ্কলন জায়গা করে নিয়েছে। অসংখ্য ভাষায় অনুবাদ ছাড়াও তাঁর উপন্যাস অনুসরণে একাধিক হলিউড সিনেমা থেকে শুরু করে হালের ওয়েবসিরিজও প্রযোজিত হয়েছে। অসংখ্য সম্মাননার মধ্যে দুটি বুকার প্রাইজ, আর্থার সি ক্লার্ক অ্যাওয়ার্ড, ফ্রাৎনজ কাফকা প্রাইজ এবং পেন সেন্টার ইউ এস এ লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড উল্লেখযোগ্য।] মেয়েটার ফাঁসির সাজা হয়েছে। ফাঁসি মকুব হতে পারে, ছেলে হলে ফাঁসুড়ের চাকরি নিয়ে, আর মেয়ে হলে ফাঁসুড়েকে বিয়ে করে। কিন্তু এখন যেহেতু কোনো ফাঁসুড়েই নেই, তাই বাঁচার উপায়ও নেই। শুধু একটা মৃত্যুদণ্ড, অনন্তকালের জন্য মুলতুবি রয়েছে। আষাঢ়ে গল্প নয়, সত্যি ইতিহাস। * কয়েদখানায় আয়না থাকে না। আয়না ছাড়া বাঁচা মানে নিজেকে ছাড়া বাঁচা। মেয়েটা নিজেকে ছাড়াই বাঁচছিল। একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করল পাথরের দেওয়ালে একটা ফুটো, আর ফুটোর মধ্যে দিয়ে শোনা যায় কার যেন গলা! অন্ধকারে ভেসে আসা গলাটা কার তা জানতে না পারলেও, ওটাই হয়ে ওঠে মেয়েটার আয়না। * মৃত্যু এড়াতে চাইলে, বিশেষ করে ঘাড় মটকে, জিভ ঝুলে বেরিয়ে আসা বীভৎস মৃত্যু এড়াতে চাইলে, মেয়েটাকে বিয়ে করতেই হবে কোনো ফাঁসুড়েকে। কিন্তু কোনো ফাঁসুড়েই তো নেই। আগে তো একটা ফাঁসুড়ে বানাতে হবে। মেয়েটাকেই বানাতে হবে। ওই যে গলাটা, দেওয়ালের ওপারে, তাকে বুঝিয়ে রাজি করাতে হবে যাতে লোকটা তার নিজের পরিচয় ছেড়ে একটা নিরপেক্ষ মুখোশ পরে নেয়। মৃত্যুর মুখোশ, আইনি মৃত্যুর মুখোশ, যার চোখ আছে মুখ নেই। একটা কুষ্ঠরোগীর মুখোশ। লোকটার হাতদুটোকে নতুন করে গড়তে হবে, যাতে তারা মেয়েটারই মত ফাঁসির সাজা পাওয়া বাকি মুণ্ডুগুলোর গলায় নির্দ্বিধায় পরিয়ে দিতে পারে ফাঁসির দড়ি, শুধু মেয়েটাকে বাদ দিয়ে। একটা ফাঁসুড়েকেই বিয়ে করতেই হবে, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, তাছাড়া বিয়ে করার জন্য উপযুক্ত তেমন আর আছেটাই বা কে? * ভাবছেন মেয়েটার অপরাধটা কী? মেয়েটার ফাঁসির সাজা হয়েছে মালিকের বৌয়ের পোশাক চুরি করার জন্য। মেয়েটা একটু সুন্দর করে সাজতে চেয়েছিল। কিন্তু আইন বলছে, চাকরদের ইচ্ছে থাকতে নেই। * মেয়েটা এখন নিজের গলাকে হাতের মত ব্যবহার করছে। দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে, ভেদ করে তার গলা ধীরে ধীরে ওপারে পৌঁছয়। মেয়েটা কী এমন বলল যাতে লোকটা প্রস্তাবটা মেনে নীল? লোকটার মৃত্যুদণ্ড হয় নি, ছাড়া পেয়েই যেত। তাহলে কীসের লোভে? সম্ভবত লোকটা এমন একটা মেয়ের সঙ্গে থাকতে চায়, যার জীবন সে বাঁচিয়েছে। অন্ধকার কুয়োয় পড়ে যাওয়া একটা মেয়েকে টেনে তুলে আবার জীবনের আলো দেখিয়েছে। উদ্ধারকর্তা হবার এইটাই একমাত্র সুযোগ, একজনের কাছে হলেও, সে ফাঁসুড়ে হবার জন্য বাকিরা ঘেন্না করলেও। লোকটার জেল হয়েছিল তলোয়ার দিয়ে একজনের ডান হাতের একটা আঙুলে আঘাত করার জন্য। সেও এক ইতিহাস বটে। * আমার দুই বন্ধু, দুজনেই মেয়ে, তাদের গল্প আমায় বলেছে। যে গল্প সত্যি, কিন্তু কেউ বিশ্বাস করবে না। সেসব ভয়াবহ ঘটনা, যা আমার সঙ্গে ঘটেনি। বলা ভালো সেসব ঘটনা আমার সঙ্গে ‘এখনো পর্যন্ত’ ঘটেনি। অর্থাৎ সেসব ঘটনা আমার সঙ্গেও ঘটেছে, শুধুমাত্র আমরা সেসময় একসঙ্গে ছিলাম না। অবিশ্বাস আসলে আমাদের ভয়। ভাবি, এসব আমাদের সঙ্গে হবে না, হতেই পারেনা। এইতো এখন কী সুন্দর বিকেল, বিকেলবেলায় এসব মোটেই হয় না। আমার বন্ধু বলল “কী জানিস, আমি চশমাটা পরার সময় অব্দি পাইনি, চশমা ছাড়া আমি বাদুড়ের মত কানা, তাই দেখতেও পাইনি যে কে বা কারা”। আসলে ঘটনাগুলো ঘটে যায়, তারপর আমরা খাবার টেবিলে বসে গল্পগুলো বলি, শুনি, যাতে শেষমেশ বিশ্বাস করতে পারি। আষাঢ়ে গল্প নয়, ইতিহাস। ফাঁসুড়ে একজন নয়, অনেক ছিল, আর এই কারণেই তারা বেশিরভাগই বেকার। * লোকটা বলেছিল: দেওয়াল নেই, ফাঁসির দড়ি নেই, খোলা দরজা, একটা মাঠ, হাওয়া, একটা বাড়ি, সূর্য, টেবিল, আপেল। মেয়েটা বলেছিল: বুক, হাত, ঠোঁট, মদ, কোমর, চুল, রুটি, পায়ের গোছ,চোখ, চোখ। দুজনেই দুজনের কথা রেখেছে। * ফাঁসুড়ে লোকটা খারাপ না। ফ্রিজ খুলে পড়ে থাকা খাবারগুলো ফেলে দেয়, কিন্তু অসাবধানে চলকে বা ছিটকে কিছু পড়ে গেলে সেটা আর মোছে না। লোকটা কিছু সাধারণ জিনিস চায়। একটা বসার চেয়ার, একটা জুতো খুলে দেবার মানুষ, কথা বললে শোনার মানুষ, ভয় আর সম্মান দিয়ে শোনার, কৃতজ্ঞতাও চায় দরকার হলে। একটা মানুষ যার ওপর নিজেকে ছেড়ে দিয়ে বা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিশ্রাম নেওয়া যায়, ঝরঝরে হয়ে ওঠা যায়। এইসবই পাওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায় হল ফাঁসির সাজা হওয়া একটা মেয়েকে বিয়ে করা, যে মেয়েটা একটু সাজতে চেয়েছিল বলে তাকে শাস্তি দিয়েছে কতগুলো পুরুষমানুষ। এরকম মেয়ের অভাব নেই। * সবাই বলেছিল লোকটা বোকা সব্বাই বলেছিল মেয়েটা খুব চালাক। বলেছিল লোকটাকে ফাঁদে ফেলেছে মেয়েটা। * লোকটা আর মেয়েটা প্রথম যখন বাসরঘরে একা হতে পারল, কী বলেছিল একে অপরকে? কী বলেছিল লোকটা, যখন মেয়েটা তার ঘোমটা সরাতে প্রথম দেখতে পেল যে সে শুধুই একটা গলা নয়, একটা রক্তমাংসের শরীরও? মেয়েটা কী বলেছিল যখন বুঝতে পারল যে সে একটা কয়েদ থেকে আরেকটা কয়েদে এসে পড়ল? তারা প্রেমের কথাই বলেছিল অবশ্য। কিন্তু প্রেমের কথা আর কতক্ষণই বা চালানো যায়। * ব্যাপারটা হচ্ছে, আমি এমন কোনো গল্পই জানিনা যা আমার বন্ধুদের বললে তারা একটু স্বস্তি পাবে। ইতিহাস তো মুছে ফেলা যায় না। বড়জোর অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে একটু শান্ত করা যায় নিজেকে। সেসময় কোনো মহিলা ফাঁসুড়ে ছিল না। বোধহয় কোনদিনই ছিল না। তাই কোনো পুরুষ, মহিলা ফাঁসুড়েকে বিয়ে করে মৃত্যুদণ্ড এড়াতে পারে নি। মেয়েরা অবশ্য পেরেছে, আইনানুযায়ী। * লোকটা বলেছিল: পা, জুতো, নিয়ম কানুন, শহর, মুঠি, রাস্তা, সময়, ছুরি। মেয়েটা বলেছিল: জল, রাত, গাছ, দড়ি চুল, মাটি, পেট, গুহা, মাংস, কাফন মুক্ত, রক্ত। দুজনেই দুজনের কথা রেখেছিল। [ অনুবাদকের নোট: ১৭৫১ সালে জ্যঁ কোলোলিয়ার নামে কিউবেক উপনিবেশ এর একজন ড্রামবাদকের জেল হয়েছিল ডুয়েল লড়ার জন্য। কয়েদে পাশের সেল এ ছিল ফ্রাংকোয়েস লরেন্ট নামে এক মহিলা যার ফাঁসির আদেশ হয়েছিল চুরির অপরাধে। সেসময় সাজা মাফ করার আদেশ ছাড়া মৃত্যুদণ্ড এড়ানোর উপায় একমাত্র ছিল,পুরুষ হলে নিজেই ফাঁসুড়ে বনে যাওয়া, আর মেয়ে হলে কোনো ফাঁসুড়েকে বিয়ে করা। ফ্রাংকোয়েস কলোলিয়ারকে খালি থাকা ফাঁসুড়ের পদের জন্য আবেদন করতে এবং তাকে বিয়ে করতে রাজি করায় । —Condensed from the Dictionary of Canadian Biography, Volume III, 1741-1770]
1 Comment
|