গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর সাদা আর লাল রঙের চিত্রা গাইয়ের ফুন্দে আর পুটকিতে তৃতীয় দিনের মতো হামিদ মিয়ার মুখ চেপে ধরা হলে, সুরত মিয়া গ্রামের সামনে, ফুটবল খেলার মাঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা কড়ছ গাছ থেকে বর্ষার ভাসানপানিতে লাফিয়ে পড়েন। ফুটবল খেলার মাঠ থেকে গিয়াস চৌধুরীর বাড়ি খুব একটা দূরে না। সুরত মিয়া, যাকে সবাই সুরত মুক্তি নামেই ডাকে, তাঁর এমন লাফিয়ে পড়ার শব্দ গাইয়ের পুটকিতে নাক মুখ গোঁজে থাকা তাঁর ছোট ছেলে হামিদ মিয়ার কানে এসে হয়তো পৌঁছায়। কিন্তু উড়ো একটা শব্দের পেছনে সময় ব্যয় করার মতো অবস্থায় সে তখন নেই। সে তখন ব্যস্ত তাঁর মুখটা গিয়াস চৌধুরীর হাত থেকে ছাড়াতে, গাইয়ের পুটকি আর ফুন্দের চারপাশে লেগে থাকা লেদা এবং ছেনা থেকে নিজের মুখ বাঁচাতে। উড়ে আসা শব্দটা যে তাঁর বাপের গাছ থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়ার শব্দ সেটা সে কিভাবে জানবে? তাছাড়া যে বাপ তিনদিন ধরে জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে চৌকিতে শুয়ে আবুল তাবুল বকছিলো, সে কিভাবে গাছের আগডাল থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়বে? সুতরাং ভোরের বাতাস যদিওবা তাঁর কানে শব্দটা এনে পৌঁছিয়ে দেয় তবুও সে তাতে গুরুত্ব দেয় না। তবে শব্দটা শোনার পরপরই কারো কারো চোখ সেটার উৎস খুঁজতে থাকে! যারা ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরছিলো, তাঁদের কেউ কেউ গ্রামের মাঝের বাড়ি কিংবা নয়া বাড়ির সাঁকোতে দাঁড়িয়েই শব্দটি শুনেছে এবং সাথে সাথেই তাঁদের চোখ চলে যায় সামনের মাঠের দিকে। লাফিয়ে পড়ার ফলে মাঠের স্থির পানিতে ঢেউয়ের যে খেলা শুরু হয়, সেই ঢেউ আরো পশ্চিমে গিয়ে বাড়িগুলোর সামনে বাঁশ দিয়ে তৈরি আড়ে এসে বারি খেয়ে বিলীন হয়ে যায়, সেই দৃশ্যও কারো কারো চোখে ধরা পড়ে। কিন্তু তখনও ভোরের আবছা অন্ধকার থাকায় গাছ থেকে পড়ে যাওয়া মানুষকে চেনা যায়নি। আরো কিছু সময় পর, চিলাউড়া গ্রামের উপর দিয়ে, গৃহস্থের বাড়ির শাক সবজির বিছড়ায় ফাল্গুন মাসের পেকে যাওয়া লাল টমেটোর মতো একখানা সূর্য দেখা দিলে সবকিছু পরিষ্কার হতে থাকে। তখন মাঠের পাশে, বয়ে যাওয়া সুরাই নদীর পাশের সেই কড়ছ গাছের আগায় একজন মানুষকে দেখা যায়। হাড্ডিসার, লম্বা, উদোম শরীর, ল্যাঙটি দেয়া লুঙি। টাক মাথায় লেগে থাকা পানিতে সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছিলো যেন বা ঘরের নতুন টিনের চালে সূর্যের আলো এসে পড়েছে। তখনই মানুষ চিনতে পারে সুরত মুক্তিকে। আবার মুহূর্তের মধ্যেই লাফ দিয়ে পানিতে পড়েন সুরত মুক্তি। তারপর আবার পানি থেকে গাছে ওঠা, আবার লাফিয়ে পড়া। এভাবে দিনে কত বার যে সুরত মুক্তি গাছের আগায় ওঠে আর লাফিয়ে পড়ে সেই হিসাব কেউ দিতে পারবে না। বেলা গড়িয়ে গেলে, সূর্যের উত্তাপ বাড়তে বাড়তে হাওড়ের পানি মৃদু গরম হয়ে পড়লে সুরত মুক্তির লাফিয়ে পড়া কিছুটা কমে আসে। কিন্তু তখন তাঁর মুখ খুলে যায়, সেই মুখ দিয়ে অনর্গল গালি বের হতে থাকে! অনেকেই অনেক চেষ্টা করে সুরত মুক্তিকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু কেউ পারে না, গাছে উঠতে গেলেই কড়ছের ডাল ভেঙে মারতে শুরু করে। শেষে সবাই, “ইবেটা ফাগল অইগছে” বলে বাড়ি ফিরে যায়। তিন দিনের জ্বরে ভোগে সুরত মুক্তি পাগল হয়ে যায়। তাঁর পাগল হয়ে যাওয়া কি অনিবার্য ছিলো? যেমন অনিবার্য ছিলো হারিসের পাগল হয়ে যাওয়া! হারিসের পাগল হওয়া তো ছিলো বংশ পরম্পরায়, যেমন তাঁর দাদা হয়েছিলেন, তাঁর চাচা হয়েছিলেন। কিন্তু সুরত মিয়ার তো এমন কিছু ছিলো না! তাহলে কীভাবে তিন দিনের জ্বরে ভুগে সে পাগল হয়ে গেলো! কেউ তাঁর পাগল হয়ে যাওয়ার কোনো হদিস খোঁজে পায় না! দিন গড়িয়ে যায়। একদিন, দুইদিন, তিনদিন করে দিন চলে গেলেও সুরত মুক্তি একইভাবে গাছ থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়তে পড়তে গালিগালাজ করতে থাকেন। মানুষের আড্ডা কিংবা উত্তেজনার জায়গা এখন সুরত মুক্তি দখল করে নেন। বাজারে রাশেদ মিয়ার কাপড়ের দোকানে বিক্রি বাট্টা বাড়ে না কিন্তু আলাপের মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। দোকানের চৌকিতে বসে থাকা কেউ রাড়ইলের, জারলিয়ার, টংগরের কেউবা তারপাশার। প্ল্যাস্টিকের টুলে বসে থাকা তারাপাশার নিয়ামত উল্লাহ বলে উঠে, “ইগুর ফাগ্লের দুস আজকে থেকি নায়। তাঁর বড় ফুয়া মারা গিয়া যে হক্কল জমিন গিয়াসুদ্দির গেছে বেছিলিছলো হউ সময় থেকি মাথাত দুশে ধরছিল।” বর্ষায় এই হাওর অঞ্চল ছয় মাস পানিতে ডুবে থাকে। খেতকিরির কোনো কাজ নেই, সবাই ঝিম ধরে বসে থাকে। বাড়িতে বসে বসে কেউ কেউ একবেলা হাওরের পানিতে মাছ ধরতে যায়, সকালে একবার নৌকা নিয়ে গরুর জন্য কচুরিপানা কাটতে যায়, সকালে গরু গোয়ালে নিয়ে বাঁধা, খড়-পানি-চিটা খাওয়ানো, গোয়াল ঘর পরিষ্কার করা, কাজ বলতে তো এই যা! বিকাল হলে গ্রামের আবাল বৃদ্ধ সবাই ষোল গুটি বা গাফলা কিংবা কম বয়সী ছোকরারা মার্বেল খেলতে বসে যায়। কেউ কেউ বাজারে গিয়ে ক্যারাম খেলে, তাস খেলে, চা খায়, গল্পগুজব করে। অফুরন্ত অবসরে এই মানুষগুলো এবার সময় কাটানোর নতুন বিষয় পেয়ে যায়। তাঁরা সুরত মিয়াকে নিয়ে মেতে ওঠে। মানুষ তখন সুরত মিয়ার পাগল হওয়ার নানা সূত্র খোঁজে, নানা যোগ বিয়োগ মিলায়! নামাজ পড়ে মসজিদের ঘাটে বসে থাকা মুসল্লির কেউ কেউ মৃদু কণ্ঠে বলতে থাকে, সুরত মুক্তি ইলেকশনের পরের দিন রাতে ঘরে ফিরে যখন শোনে তাঁর মেয়ের জামাইকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে তখন থেকেই সে পাগল হতে শুরু করে। কেউ আবার বলতে থাকে গিয়াস উদ্দিন প্রথম যেদিন তাঁর মিলিটারির মতো হাত দিয়ে সুরত মুক্তির ছোট ছেলে হামিদের মুখ তাঁর গাইয়ের ফুন্দের সাথে চেপে ধরে সেই খবর শোনেই সে জ্বরে আক্রান্ত হয়, সেখান থেকেই একেবারে পাগল হয়ে যায়। গাছে ওঠার তিনদিনের দিন আসরের বেলা, সুরত মুক্তি কড়ছ গাছের বড় একটা ডালে প্রায় নিস্তেজ হয়ে বসে থাকেন। হয়তো তাঁর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে কিংবা এমনিতেই ক্লান্ত হয়ে বসে আছেন। গ্রামের কাউয়ুম হাজাম তখন বাল্লা বিলে কারেন্টের জাল দিয়ে মাছ ধরে বাড়ি ফিরছেন। মাঠের পাশে থাকা কড়ছ গাছের কাছে আসতেই কাউয়ুম হাজামকে চমকে উঠতে হয়! হ্যাঁ তাঁকে চমকে উঠতেই হয়! গাছের উপরে সুরত মিয়ার মুখামুখি বসা দিলারা নটি! হাজাম বারবার তাকায়, বারবার একই মানুষকে আবিষ্কার করে, দিলারাকেই! এই তো এবার যে তাঁর হাসিও শোনা যাচ্ছে! সেই পুরনো কলকল শব্দের হাসি! কাউয়ুম হাজামের মাথা ঘুরে, সে বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়, কখনো মনে হয় দিলারা কোনো দূর দেশে স্বামীর ঘর করতে গেছিলো আবার পরমুহূর্তেই তাঁর মনে পড়ে সেই নিঃসঙ্গ সকালের কথা! ছিয়াত্তর সনের কথা, হিজল গাছে দিলারার লাশ ঝুলে থাকার কথা। ছিয়াত্তর সনের মাঘ মাসের এক ভোরে নয়াবাড়ির কেউ একজন ঊকুইন দিয়ে পাশের বিল থেকে ক্ষেতে পানি দিতে যাবে বলে বাড়ি থেকে বের হতেই দেখে বাড়ির সামনে সারি বাঁধা হিজল গাছের একটা ডালে দিলারার লাশ ঝুলে আছে! কাউয়ুম হাজাম হাতের শক্তি বাড়ায়, বৈঠা দ্রুত চালাতে থাকে। কিন্তু সুরত মিয়াকে এড়িয়ে যেতে পারেন না! গাছ থেকে সুরত মুক্তি কাউয়ুম হাজামকে ডাক দেন, কাউয়ুম হাজাম সুরত মিয়ার ডাক না শোনার ভান করে দ্রুত চলে যায়। সুরত মুক্তি জোরে জোরে হাসে। গল্প করে দিলারার সাথে। দিলারার মরে যাওয়ার আগে কি কখনো সুরত মুক্তি তাঁর সাথে এভাবে কথা বলেছিলো? সে কোনোভাবেই কিছু মনে করতে পারে না। “ফাওগল অইগেছি অনে আর কিতা মনও পরব? হক্কলতা ভুলি গেছি!” সুরত মুক্তি এই বলে জোরে জোরে হাসে! দিলারাও হয়তো তাঁর হাসিতে যোগ দেয়। পাগল হয়ে গেলেও তখন যেনো সুরত মুক্তি ক্ষণিকের জন্য ভালো হয়ে যায়! মনের কোণে উঁকি দেয় দিলারার প্রথম স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে আসার দিন! উঁকি দেয় দ্বিতীয় বিয়ের দিন তা ভেঙে দিয়ে বরযাত্রী সবাই দিলারাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার দৃশ্য। সুরত মুক্তির কানে সেদিনকার গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর কথা ভেসে আসে! তাঁর থেকে হাত দশেক দূরে বসেই তো সে বরের এক চাচাকে বলছিলো, “......দামান্দের দুই নম্বর বিয়াতে কিতা অইছে বা, বেটাইন্তের লাগি আরকবার কইন্নার অভাব নি? ......হেশেদি আইয়া নটি বেটি নেওয়া লাগে নিবা? কিতা কইন বাইছাবে? নটিবেটি নিতাম কেনে? তুমিতাইন কুন্তা জানও নানি বা! সংগ্রামের সময় পাইঞ্জাবীর গেছে নু আছিল।...... আগর বিয়াও এরলাগি ভাংছিল!” আর কিছু বলতে হয় না! বিয়েটা এখানেই ভেঙে যায়। গিয়াস উদ্দিন বলেন না, সে-ই দিলারাকে পাঞ্জাবীর স্টিমারে ধরে নিয়ে দিয়ে আসছিলো। এতো বছর পর, তারাপাশার শত শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এই কড়ছ গাছের ডালে মরে যাওয়া দিলারাকে সামনে রেখে সুরত মুক্তি বিড়বিড় করে সে কথাই বলে, তারপর আবারো মুখের গালি শুরু হয়ে যায়। গায়ের একমাত্র মুক্তি সুরত মিয়া! দালালও সেই একজনই ছিলো, গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী! সুরত মুক্তি আর দালাল গিয়াস উদ্দিন এখনো বেঁচে আছেন কিন্তু বীরাঙ্গনা দিলারা বেগম উঠতে বসতে গ্রামের মানুষের মুখে নটি বেটি নটি বেটি শোনতে শোনতে মৃত্যুকে বেছে নেন! গিয়াস উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে সুরত মুক্তি গালি দিতে থাকেন। লেরখাউরার ফুয়ারে আমি ডরাইনি? ই লেরখাউরায় সংগ্রামের সময় কত মুক্তিরে ধরাইয়া দিলো, কত মানুষ মারলো। সংগ্রামের পরেও কতো মানুষ মারলো। জাইল্লার গাঙ্গও মার্ডার খরলো। মাইনশের খেতকিরি লুইট্টা খাইয়াও শান্তি অইছে না! আমার আবাবমিয়ারে হে খাইলো, আমার সব জমিনও গিলিলিলো, অনে আইসে আমার হামিদমিয়ারে গরুর চেনা খাওয়াইয়া মারতো! ........দলালওখলতেরে আমি অখন আর ডরাই না, ডরানির দিন গেছেগি, এবুলকা ই চুত্মারানীর ফুয়ারে লইয়া মরমু বলে গাল দিতে দিতে নিস্তেজ হয়েই গাছের বড় একটা ডালে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকেন। শীর্ণ দেহটা যেনবা গাছেরই আরেকটা ডাল। এই তিন দিনে তাঁর শরীর আরো শুকিয়ে গেছে, তিন দিনে গাছে থেকেই মাত্র দুবেলা ভাত খেয়েছেন। সুরত মুক্তি গাছের উপর নেতিয়ে পড়ে থাকেন, তাঁর এই শীর্ণ শরীরটাকে গাছের একটা ডাল ভেবেই হয়তো একটা মইসাপ তাঁর পেটের উপর দিয়ে চলে চলে যায়! তাঁর চোখে হয়তো একসময় ঘুম আসে। কিন্তু অনেক পরে যখন তাঁর ঘুম ভাঙ্গে তখন তিনি নিজেকে তাঁর টিনের ঘরের ভেতরই আবিষ্কার করেন। টিনের চালে ঝুম বৃষ্টি পড়ার শব্দ তাঁর কানে আসে। বছর তিনেক আগে মরে যাওয়া তাঁর বড় ছেলে আবাব মিয়ার বৌকে দেখা যায় ঘরের চালের যে যে জায়গায় পানি পড়ে সেখানে ডেগ ডেকসি রেখে দিতে, নয়তো ঘরের ভেতর পানির বন্যা শুরু হয়ে যাবে। আবাব মিয়ার বৌকে দেখে তাঁর মুখ আবারো খুলে যায়। এবার আর গিয়াস উদ্দিনকে গালি দেন না, তাঁর ছেলেকেই দেন! “মরবে যেবলা মরিযা! আমারেজুন দলালের ফাওর চিফাত ফালাইয়া নিয়া মারতে?” আবাব মিয়া চার বছর আগে মারা যায়। মেরুদণ্ড ভেঙে মারা যায়। সেই সাথে মেরুদণ্ড ভেঙে যায় গোটা একটা পরিবারের। বছর চারেক আগে, দেশের উন্নয়ন চাকা যখন সবে মাত্র ঘুরতে শুরু করে, সেই সাথে লুটের চাকা, চেতনাবাজীর চাকা, তখনি সুনামগঞ্জের সকল হাওর এক অকাল বন্যায় তলিয়ে যায়। এক মুঠো ধানও সেবার কাটা যায়নি। সরকার থেকে সাহায্য আসে, এনজিও থেকে আসে। কিন্তু দু মাস পরই ঘরের সব খাবার শেষ হয়ে যায়। বেঁচে থাকার জন্য যখন এই গ্রামের যুবক আর প্রৌঢ়রা জীবনের প্রথমবারের মতো ঢাকা শহরে পাড়ি দেয় তখন তাঁদের সঙ্গী হয় আবাব মিয়াও। কিন্তু মৃত্যু যেখানে নিয়তি সেখানে বেঁচে থাকা কি এতো সহজ! সাত তলা বিল্ডিঙে নির্মাণ কাজ করতে করতেই একদিন নিচে পড়ে যায়। সাথে সাথেই মরে না। দিন দশেক বেঁচে থাকে, হাসপাতালে। এই দেশ এমনি এক দেশ সেখানে চিকিৎসার জন্য কড়ি কড়ি টাকা ঢালতে হয়। নয়তো চিকিৎসা মিলবে না, রাস্তায় পড়ে থেকে মরতে হবে! সুরত মুক্তিও নিজের সব সম্পদ ঢেলে দেন হাসপাতালে। এই দশ দিনে গিয়াস উদ্দিনের কাছে সুরত মুক্তির সব অহংকার মাটিতে মিশে যায়, তাঁর জমি কিনে নেয়ার জন্য গিয়াসউদ্দিনের পায়ে পড়েন! যদি দালাল বিত্তশালী হয়, ক্ষমতাবান হয়, বেঁচে থাকার জন্য তাঁর পায়ে পড়তেই হয়! তখন তাকে ক্ষণিকের জন্য ভুলে যেতে হয় মুক্তিযুদ্ধের কথা! তাকে ভুলে যেতে হয় মিলিটারির লঞ্চের ভেতরে নিজের সর্বস্ব হারানো দিলারা বেগমের আত্ম-চিৎকারকে পাশে ফেলে মিলিটারির প্রতি গিয়াসউদ্দিনের কৃতজ্ঞতার হাসি! জমি বিক্রি হয়, টাকা খরচ হয় কিন্তু আবাব মিয়ার আর বেঁচে থাকা হয় না। দেড় বছরের সন্তান রেখেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। বেঁচে থাকার জন্য সুরত মুক্তির কাছে তখন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না! স্বাধীন দেশে একজন মুক্তি তাঁর ছেলেকে বাঁচানোর জন্য, নিজেকে বাঁচানোর জন্য, দালালের পায়ে গিয়ে পড়ার, তাঁর অনুগ্রহ পেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করার চেয়ে ছোট আর কীইবা থাকতে পারে? তবুও তো আমাদের বেঁচে থাকতে হয়! কিন্তু ভাঁড়ালে ধান, মখটিতে চাল না থাকলে কিভাবে বেঁচে থাকা যায় সেই হিসাব সুরত মুক্তি করতে পারেন না! যখন যৌবন ছিলো, শক্তি ছিলো, তখন বেঁচে থাকার ভিন্ন হিসাব করা যেতো। অন্য কারো হিসাবের খাতা বন্ধ করে হলেও বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করা যেতো। যেমন করেছিলো ’৭৪ সনে। মদব্বির ডাকাতের কাছে গিয়ে তিনিই তো বলেছিলেন, “মদব্বির বাই, ফেটও ভাত নাই, উগারো ধান নাই। কিচ্ছু একটা তো করা লাগবো। আমারে তুমার দলও ঢুকাও।” হ্যাঁ তাঁর সবকিছুই মনে আছে, যে বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলো এবার সে সেই বন্দুক দিয়েই কুশিয়ারা নদীতে গুলি ছোঁড়ে, লঞ্চ ডাকাতি করে! আরো কয়েকটা বছর তাঁকে এভাবেই চলতে হয়। কিন্তু সেই যৌবন এখন আর নেই। হাড্ডিসার দেহ নিয়ে এখন সে কীইবা করতে পারে? এবার সে চুরির পথই বেছে নেয়! কিন্তু কীইবা চুরি করবে? সবারই তো একই দশা, এক গিয়াসউদ্দিন ছাড়া! ধানের ব্যাপারী গিয়াসউদ্দিনের ধানের ভাঁড়ালের তালা ভেঙে ধান চুরি করতে গিয়ে সুরত মুক্তি ধরা খেয়ে যান! বিচার হয় না। চড় থাপ্পড়, জুতা বারি খেয়েই বেঁচে থাকেন। কিভাবে কিভাবে যেন সে বছরটা কাঁটিয়ে দেন। কিন্তু পরের বছরেই তাঁকে আবার গিয়াসউদ্দিনের বাড়িতে ছুটতে হয়। চৈত্র মাসের এক মাগরিবের নামজের পড়ে মসজিদ থেকে নেমে হাঁটা শুরু করেন নদীপাড় ধরে দক্ষিণের গ্রাম জারলিয়ার দিকে। বেতাউকা গ্রামের উপর দিয়ে, অগ্নি কোণ দিয়ে বয়ে আসে বাতাস, নদীর উপর দিয়ে আসতে আসতে চৈত্রের গরম বাতাস শীতল হয়ে যায়। বাতাসে পাতলা পাঞ্জাবীটা ওড়ে, বুকে এসে বাতাস লাগে কিন্তু মনে এই বাতাস ছোঁয়ে যায় না। মন বড় অশান্ত! ‘চইতমাসের নিদান’ যে কতোটা ভয়াবহ তা হাওরপাড়ের একজন মানুষই শুধু বুঝতে পারে। এই মাসে শেষ হতে হতে সব কিছু শেষ হয়ে যায়, কারো হাতে তো টাকা থাকেই না, যাই থাকে তাও শেষ হয়ে যায়। ভাঁড়ালের ধান শেষ হয়ে যায়, মখটির চাল শেষ হয়ে যায়, গরুকে খাওয়ানোর খড়ও শেষ হয়ে যায়। এতোই নিদান পড়ে যে নদীর পানি, বিলের পানি শুকিয়ে যায়, হারিয়ে যায় মাছ। এই নিদানবেলা সুরত মুক্তির মনে শান্তি ফিরবে না। তিনি নদী পাড় দিয়ে হেঁটে হেঁটে জারলিয়ার খেয়া ঘাটে চলে যান। সন্ধ্যার আকাশের আধো আধো অন্ধকার মিলিয়ে গিয়ে রাত হয়ে গেলে খেয়া ঘাটে হিজল গাছের নিচে সুরত মুক্তিকে বসে থাকতে দেখা যায়। গ্রামের কোনো এক ছেলে হয়তো কোথাও থেকে খেয়া পার হয়ে বাড়ি ফিরছিলো, সে সুরত মুক্তিকে হিজল গাছের নিচে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করে, “কিতাবা সুরত চাচা, গোদারা ঘাটও কিতা করো? যাইতায়গিনি বাড়িত?” কিন্তু কোনো উত্তর মিলে না। ছেলেটাও অপেক্ষা না করে চলে যায়। আরো বেশ কিছু সময় পরে, আকাশে চাঁদ উঠলে এই পৃথিবী নতুন আরেকটা রূপে হাজির হয়। সারা পৃথিবী চাঁদের আলোয় যেন-বা একটা কালো দুঃখী চাদরে ঢাকা পরে যায়। এই হাতের কাছেই হাওর, বিল, ডোবা, হাওরের ক্ষেতে কৃষকের কাঁচা ধান কিংবা গ্রামের সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরাই নদী, সবকিছুই যেন এই চাঁদের আলোয় কৈশোরে মা হারানোর বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া কিশোরী হয়ে যায়। এমন দুঃখী দুঃখী রাতে সুরত মুক্তি গিয়াসউদ্দিনের বাংলা ঘরে গিয়ে হাজির হন। গিয়াসউদ্দিনের দেখা পেলে সুরত মুক্তি তাঁর বাম হাত দিয়ে ডান পাশের পিঠ চুলকাতে চুলকতেই বলেন “বাইছাব আমার ফুয়াগুতারে তুমার ঘরও ইবার বাইরাত রাখবায় নি? হে সব খাম খরতা ফারে।” এভাবেই এক দুঃখভরা রাতে বেঁচে থাকার জন্য তাঁর ১৪ বছরের ছোট ছেলে হামিদ মিয়াকে বর্ষার ছ’মাসের জন্য পনেরো হাজার টাকা, একটা লুঙি এবং একটা গামছায় গিয়াসউদ্দিনের ঘরে কামলা দিয়ে আসেন সুরত মুক্তি। এখন এই বর্ষায় গিয়াস উদ্দিন বড় আনন্দের একটা কাজ পেয়ে গেছেন! হামিদ মিয়ার মুখ সুযোগ পেলেই তিনি তাঁর সদ্য বিয়ানো গাইয়ের পুটকির সাথে চেপে ধরেন, পরম আনন্দে! এই নিয়ে তিন দিন এভাবেই তাকে চেপে ধরেন গিয়াস উদ্দিন। হামিদ মিয়া গাইয়ের পুটকির গন্ধ শুঁকে, কখনোবা তাঁর মুখ গাইয়ের পুটকিতে লেগে থাকা লেদা ছেনায় লেগে যায়! কোনোভাবেই সে নিজেকে এ থেকে বাঁচাতে পারে না। ক’দিন আগে গিয়াস উদ্দিনের গাইটা ভোর রাতে বিয়ায়। বিয়ানোর কয়কঘন্টা পর যখন গাই তাঁর ইল্লত ছেড়ে দেয় তখন সেটা আর হামিদ মিয়া দেখে নাই। ফলত, গাই তাঁর ইল্লত নিজেই খেয়ে ফেলে। সকালে যখন গিয়াসউদ্দিন জিগায় ইল্লত ফেলেছে কিনা? হামিদ মিয়া কোনো কথা বলে না। এক সময় গিয়াসউদ্দিনের চিল্লানি খেয়ে তাঁর মাথা ডানে বায়ে ঘুরায়। না বোধক উত্তর শোনে গিয়াসউদ্দিনের মাথায় আগুন ওঠে। ইল্লত খেয়ে ফেলায় গাইয়ে দুধ দেয়া কমে যাবে ভেবে গিয়াসউদ্দিন চিৎকার করে হামিদকে তাঁর বাপের নামে কিছু বলে কিন্তু কিছুই বুঝা যায় না, গিয়াসউদ্দিনও হয়তো বুঝতে পারে তাঁর কথা কিছুই বুঝা যায় নি। তখন তাঁর মিলিটারির হাতের মতো হাত দিয়ে বালক হামিদের মাথায় থাপ্পড় দেয়, থাপ্পড় খেয়ে তাঁর সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা সদ্য বিয়ানো গাইয়ের পাছায় গিয়ে তাঁর মাথা বারি খায়। তারপর আবারো থাপ্পড় মারেন, তবে এবার তাঁর মুখ গিয়ে লাগে একদম গাইয়ের ফুন্দে, সাথে সাথে তাঁর মাথাকে গিয়াসউদ্দিন গাইয়ের ফুন্দের সাথে চেপে ধরেন, সেখানে লেগে থাকা রক্ত, ছেনা সবই তাঁর মুখে ঠোটে লাগতে থাকে। সদ্য বিয়ানো গাই খুব একটা নাড়াচাড়া করতে পারে না, হামিদ মিয়াও গিয়াসউদ্দিনের মিলিটারির হাত থেকে বের হতে পারে না। এভাবে অনেক বার থাপ্পড় খেতে খেতে মুখ দিয়ে তাঁর রক্ত বের হয়। ছেনা-গোবর খাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানো চেয়ে তখন তাঁর নিজেকে বাঁচানোই অনেক বড় হয়ে দেখে দেয়। এক সময় দৈত্য থামে, হামিদ বাড়ি দৌড়ে! ছেলেকে এভাবে দেখে সুরত মুক্তি ঝিম মেরে বসে থাকেন, একটা শব্দও তাঁর মুখ দিয়ে বের হয়নি। ঠিক কত সময় এভাবে বসে থাকেন সেটা তাঁর বাড়ির কেউ খোঁজ না রাখলেও দেখা যায় দু’দিন পর সুরত মুক্তির জ্বর আসে। সুরত মুক্তি তাঁর এতো কিছুর জন্য দায়ী বড় ছেলেটাকে তাই সে গালাগালি করছিলেন। তাঁর সারা শরীর জ্বরে কাঁপছিলো, মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিলো না তবুও গালি দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। তাঁর গালির শব্দ চাপিয়ে তখন তাঁর নাতি, আবাব মিয়ার তিন বছরের ছেলে রিয়াদের কান্না শোনা যায়। তাঁর কান্নায় তাঁর মা “অত অত জ্বালনি, অত জ্বালানি জ্বালাও খেনে” বলে গুড়ুম গুড়ুম করে তাঁর পিঠে কিল দিতে থাকে! মাইর খেয়ে রিয়াদের কান্না যখন টিনের চালের বৃষ্টির শব্দকে হারিয়ে দিচ্ছিলো তখন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঘরে ঢুকে তাঁর মেয়ে হাফিজা বেগম। কাঁখে এক বছরের মেয়েটা, হাতে ধরা সাড়ে তিন বছরের মেয়ে, মেয়ে দুটোও একদম কাঁকভেজা। সুরত মুক্তির গালি থেমে যায়। মেয়েটি কি তাঁর পাগল বাপকে দেখতে এসেছে? নাকি তাকে একেবারে বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে? ছ’মাস ধরে তাঁর স্বামী জেলে! সুরত মুক্তি মনে করতে চেষ্টা করেন, ইলেকশনের দু’দিন পরেই তো তাকে পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। পাগল হয়েও তিনি স্পষ্ট সে রাতের কথা মনে করতে পারেন। শীতের রাত। আব্দুল আলীর বাংলায় এফএম রেডিওতে বিবিসির খবর শোনছিলেন, একসময় শোনেন সরকারী দলকে ভোট না দেয়ায় সুবর্ণচরে চার সন্তানের এক মাকে সরকারী দলের নেতারা ধর্ষণ করে। হঠাৎ করেই বুকটা ধক করে ওঠে, যেমন ধক করে ওঠে এই চার সন্তানের মায়ের জন্য তেমনি তাঁর নিজের মেয়ে হাফিজার জন্যও! হাফিজার স্বামী আবার অন্য আরেক দলের এক নেতার খুব কাছের লোক, পেছনে পেছনে ঘুরে। এখন না জানি তাঁর কী অবস্থা? এই চিন্তা করে করে যখন তিনি দ্রুতই বাড়ি ফিরছিলেন, ফেরার পথে নয়া বাড়ির খালে প্রথম দিনের মতো তাঁর চোখে দিলারা নটি ধরা পড়ে! তারপর বহুবার দিলারা সুরত মুক্তির সামনে আসে। সুরত মুক্তি ভুলে যেতে পারেন না দিলারার সেইসব দিনগুলোর কথা, যখন গ্রামের মানুষ ভুলে যায় দিলারার বাপ মায়ের রাখা তাঁর নাম, তখন তাঁর নতুন নাম হয়ে যায় নটিবেটি। ’৭১ একটি বিকালই তাঁকে নটি বেটি বানিয়ে ফেলে! সদ্য বিয়ে করা স্বামীর ঘরটাও তাঁকে সেই বিকালের কারণে হারিয়ে ফেলতে হয়। অথচ তারাপাশার আকাশে সেই বিকেল নিয়ে আসা দেশবেশ্যা গিয়াসউদ্দিন তখনো সুন্দর জীবন যাপন করছেন! বিচার-আচার, পঞ্চায়েত সবই তাঁর হাতেই থাকে। আরো বেশ কয়েক বছর পরে তাঁর ছেলে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়েই উপজেলা চেয়ারম্যান হয়! খুব শিগিগির হয়তো সে এমপিও হবে। দিলারাকে পাঞ্জাবীরা মারতে পারেনি। অর্ধ মৃত করে রেখে গেছিলো কিন্তু এই স্বাধীন দেশের মানুষেরাই তাকে পুরোদমে মৃত্যুকে বেছে নিতে বাধ্য করেছিলো। এই এলাকাবাসী ভুলে যাবে সেই বিকেলের নেপথ্যে থাকা মানুষটির কথা, ভুলে যাবে এই দেশের স্বাধীনতা নামক অনেক অনেক দূরের এক বস্তু পাওয়ার জন্য কোন এক অখ্যাত, হাওড়পাড়ের প্রত্যন্ত গ্রাম তারাপাশার এক মেয়ের নিজেকে বলি দেয়ার কথা। মানুষ তখন শ্লোগান দিবে দালালের ছেলের মিথ্যা মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে! শীতের সে রাতে সুরত মুক্তির মনে উঁকি দেয় ভয়, মনে প্রশ্ন জাগে, দিলারার মতোই কি সুবর্ণচরের সেই মা মারা যাবে? শুধু কি এই চার সন্তানের মা ই ধর্ষিত হন, নাকি এই দেশটা নিজেই ধর্ষিতা? দিলারাকে পাশ কাঁটিয়ে যখন সুরত মুক্তি ঘরে ফিরেন, ঘরে তখন তাঁর বউয়ের কান্না শোনা যায়। তাঁর মেয়ে জামাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে! নাশকতার অভিযোগে! হাফিজা পুরোদমে ভিজে গেছে। তাঁর কাপড় দিয়ে পানি পড়ছে। কাঁখের মেয়েটাকে ঘরে রেখেই সুরত মুক্তির তক্তপোষের পাশে যেতেই সুরত মুক্তি হাসি দিয়ে মেয়েকে বলে “আমি বেটি ফাগল অইগেছি। মাথায় খাম করে না”। সারা রাত ধরে বৃষ্টি হয়। সারা ঘর ভাঙা টিনের চালের পানিতে ভেসে গেলেও কখন যে ভোর হয় সে খবর সুরত মুক্তির ঘরের কেউ বলতে পারে না। সুরত মুক্তিকে নিয়ে ক’দিন ধরে এই পরিবারের কম ধকল পোহাতে হয়নি। আজ সবাই শান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে! কিন্তু শান্তির ঘুমে ছিঁড় ধরে মানুষের চিল্লানিতে! ঘরের মানুষ শোনতে পায় কেউ একজন বলছে, সুরত মুক্তির লাশ নাকি মাঠের মধ্যে ভেসে উঠেছে! আর তখনই সুরত মুক্তির মেয়ে হাফিজা খেয়াল করে ঘরের ভেতরে তক্তপোষে সুরত মুক্তি নেই। কখন যে রাতে ঘর থেকে তিনি বেরিয়ে গেছিলেন সেটা ঘরের কেউ খেয়ালই করেনি। যেদিন দেশের পত্রিকায় কিংবা টিভিতে বড় শিরোনাম হয়, দেশের বড় বড় ধনকুবেরদের শত শত কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ সরকার খেলাপি ঋণ বলে মওকুফ ঘোষণা করেছে, ঠিক সেদিনই সুনামগঞ্জের হাওড়পাড়ের এক অখ্যাত গ্রাম তারাপাশার মানুষেরা জোহরের আজানের আগে আগে ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে একটা ভারী লাশ বয়ে নিয়ে যায় তাঁদের গ্রামের এক হাতল ভাঙা কাঠের খাটিয়ায় করে।
0 Comments
মৃত্যুর সঠিক বয়স? শূন্য থেকে অনন্ত। তাই কাল রাতে রুবি মরে গেছে অসংখ্যবার। রুবির প্রথম মৃত্যুর খবর পেয়ে রেস্টুরেন্টে বসে ওয়েট্রেসকে খেঁকিয়েছি। পরের দু'বার ট্রেনে হিজড়েকে দেখে ঘুমনোর ভান করেছি আর ভিখিরির বাচ্চাকে খিস্তি মেরে চড় তুলেছি। হিজড়েকে খিস্তি দেওয়ার সাহস ছিল না। এই রুবি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এর ঘ্যানঘেনে উপন্যাসের রুবি নয়। এই রুবি কবিতায় লেখার রায় নয়। এমনকি এই রুবি ক্লাস সিক্সেই ক্যান্সারে মরে যাওয়া সহপাঠিনীও নয়। রুবির নাম রুবি হল কেন সেটা একটা প্রশ্ন। একাধিক মানুষের একই নাম হবে কেন? এ আবার কী কথা? এর কোনো যুক্তি নেই। রুবির নাম হতে পারত "খারাপ খবর"। কিন্তু সারাজীবন একটা মানুষের একই নাম থেকেই বা যাবে কেন? রুবির নাম "খারাপ খবর" থেকে "নিয়মনিষ্ঠা" হয়ে মরার সময় "রজনীগন্ধা" হয়ে যেতেই পারত। কিন্তু না। বার্থ সার্টিফিকেট বলছে রুবি,ডেথ সার্টিফিকেটও বলছে রুবি। অগত্যা রুবিকে আমাদের রুবি বলেই ডাকতে হবে। রুবির চতুর্থবার মৃত্যুর খবর দিতে নার্স সোজা চলে এলো বাড়িতে। সিনেমার মত। সাদা পোশাকে। রুবি নাকি চতুর্থবার মরার আগে বিড়বিড় করে বলেছিল "বেশ্যামাগী রুবি... চোর চোর চোর চোর... বেজন্মার বাচ্চা বেজন্মা রুবি... চোর চোর চোর চোর..." ইত্যাদি। আর কী কী বলেছিল নার্স ভালো শুনতে পায়নি। নার্স যখন এলো আমার তখনো হাত ধুয়ে চায়ের জল বসানো হয় নি। আমি বললাম "জানি, ভেতরে আসুন।" নার্স একটু অবাক হল যে আমি জানলাম কী করে। তারপরেই ওর নজরে পড়ল ডাক্তারের সাদা গাউন চেয়ারের ওপর পড়ে। ওর ঠোঁটের কোণে একটা মুচকি হাসি দেখা দিল। আমার দৃষ্টি এড়ায়নি বুঝে সামলে নিল। রুবির বিড়বিড় করে বলে যাওয়া কথাগুলোর পেছনের ঘটনাগুলোর খানিকটা বাথটাবে পড়ে থাকা ডাক্তারের বডিটা জানে। বাকিটা নার্সকে শোনাবো ঠিক করলাম। সিঙ্কে হাতটা ধুচ্ছি, নার্স দেখল হাতে লাল লাল তরল কিছু লেগে আছে, সিঙ্কে গড়িয়ে যাচ্ছে লাল জল। একটু সিঁটিয়ে গিয়ে বলল বাড়িতে ছোট বাচ্চা আর অসুস্থ শাশুড়িকে রেখে এসেছে। বড়জোর একটা "গল্প" শুনতে পারে, যদি নিতান্তই তা আমাকে "হেল্প" করে। "গল্প" শুনেই মাথা গরম হয়ে গেছিল, হেল্প শুনে হেসে ফেললাম। বেচারা!! আমাকে হেল্প করবে! বললাম বসুন। বসল চুপচাপ কোলে ব্যাগ আঁকড়ে ধরে। যদি খুন হবারই ভয় থাকে ব্যাগ আঁকড়ে কী করবে কে জানে!! ব্যাগে আত্মরক্ষার সরঞ্জামও কিছু নেই তা আমার আগেই জানা আছে। যাকগে। রুবি আটবছর বয়সে একবার সূর্য পৃথিবী আর চাঁদ আঁকবে বলে একটাকা, পঞ্চাশ পয়সা আর পঁচিশ পয়সার কয়েন নিয়েছিল, না বলে। সেজন্য রুবি কমপক্ষে পঁচিশবার উঠতে বসতে খেতে শুতে শুনেছিল "চোর চোর চোর চোর, চোরের বাচ্চা চোর।" তারপরে রুবি অনেকবার চুরি করেছে। কেউ ধরতে পারে নি। কারণ চুরি করা ও করে ধরা না পড়া এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। আশেপাশের মানুষজন মূলতঃ গাম্বাট প্রকৃতির এবং অমনোযোগী। কানের কাছে চেঁচিয়ে না বললে কিছু বুঝতে পারে না, চল্লিশবার বললেও পারে না, অথবা বিশ্বাস করে না। সত্যি বিশ্বাস করা কঠিন, তাই রুবি চুরির আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। নার্স উসখুস করছে।উঠে দাঁড়াল। বললাম আরেকটা ঘটনা, অন্তত আরেকটা ঘটনা আপনার শোনা দরকারী। কেন আমি রুবিকে খুনের পরামর্শও দিতাম। চোখ দিয়ে ইশারা করলাম বসতে। নার্সের নাম আইরিস, তাই সে সহজেই বুঝে গেল আমার শক্ত চোখের মণির আদেশ। রুবির গলায় সুর ছিল দেখে ছোটবেলাতেই রুবিকে গানের ক্লাসে ভর্তি করে দেওয়া হয়।বছর এগারোর রুবির একদিন রেওয়াজ করতে ইচ্ছে করছিল না। একটা বিস্ফারিত চোখ, কাঁপতে থাকা সবকটা পেশী, ঠোঁটের কোণে থুতু জমে ওঠা মুখ দাঁত কিড়মিড় করতে করতে রুবির গোল দিশেহারা মুখের সামনে এসে বলছিল "তা করবি কেন? বেশ্যাগিরি করবি, বেশ্যাগিরি। বাড়ি ফাঁকা পেলেই তো ওই মুদির দোকানের ছেলেকে ঘরে ঢোকাবি। বেশ্যামাগী।" একটা কথাও রুবি ঠিকঠাক উদ্ধার করতে পারে নি সেসময়। মুদির দোকানের ছেলেকে সে কেন বাড়িতে ঢোকাতে যাবে! আর ঢুকিয়ে করবেটাই বা কী? বেশ্যাগিরি যে কী তা না জানলেও, নিশ্চয়ই একটা ভয়ঙ্কর ভবিষ্যত তা আন্দাজ করে, সেসব এড়াতে, ঝুঁকি না নিয়ে, চোখের জল মুছে চুপচাপ রেওয়াজে বসেছিল। এসব কথা রুবি যখন আমাকে বলত, রাগে আমার গা জ্বলত,গলা টিপে দিতে ইচ্ছে করত রুবির। বলতাম "মেনে নিতিস এসব? কুত্তার বাচ্চাই বটে তুই।" রুবি করুণ চোখ তুলে বলত "কী করব? মানেই তো বুঝতাম না।আর চটি দিয়ে মারত। ছোট ছিলাম। কী করতাম? তবে যখন ভালো তখন তো ভালো থাকত। আর ভালোবাসে বলেই করত। আমার ভালোর জন্যই।" আমি খ্যা খ্যা অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলাম। "ভালোবেসে? ভালোবাসা?! পেরেন্টিং? নাকি?!! ওওওলে বাবালে!" রুবি আরও কাঁদতে থাকত, শেষে ওই বাড়িতেই ফেরত যেত "কর্তব্য" করতে। আমি রুবিকে সিধে করে তুলতেই পারতাম, কিন্তু রুবি আমার সঙ্গে থাকল না। ওই বাড়ির লোকেরা বলেছিল মেয়েতে মেয়েতে প্রেম সংসার করা নিষেধ। আমি যদিও পরে অনেকগুলো প্রেম করেছি। রুবি বিয়ে বাচ্চা করেছিল। নার্সের চোখ দেখলাম ছলছল করছে। বলল "ম্যাডাম আমি সবই বুঝতে পারছি,খুবই খারাপ লাগছে, কিন্তু ছ'টা দশের ট্রেনটা মিস করলে... বাড়িতে ছোট বাচ্চা বোঝেনই তো... খুব..." আমি জোকারের স্টাইলে দরজা খুলে দিলাম। ""আসুন। সাবধানে।" পুরুষ ডাক্তার "গল্প" শোনার গোটা সময়টা আমার বড় বড় বুকের দিকে তাকিয়ে ছিল।তাই বডি বাথটাবে। সিনেমার মতই।খুন বাথটাবে করা সুবিধেজনক। মহিলা নার্স তাকায়নি, তাই যেতে দিলাম। ভাবলাম যদি ডাক্তার মহিলা আর নার্স পুরুষ হত, তাহলেও কি ডাক্তার আমার বুকের দিকে তাকাত আর নার্স নয়? ব্যাপারটা পদ ও পেশানির্ভর, না লিঙ্গ? যাকগে।এত জটিল কথা ভেবে লাভ নেই। একটু বাদেই রুবির খুনী আসবে। আহা রুবি হাসপাতালে রোগে ভুগে মারা গেছে বারবারই, জানি। কিন্তু আসলে রুবি খুনই হয়েছে। খুন তো আর একদিনে হয় না। রুবির খুনী আসতে বাধ্য, এমন চিঠি দিয়েছি অনামে। সব সংলাপও ঠিক করে রাখা আছে। কলিং বেল বেশ কয়েকবার বাজালে তারপরে ধীরে সুস্থে গিয়ে দরজা খুলব। "কে আপনি? কী চান?" ই বলবে তা নিশ্চিত। ঘরে ঢুকতে বলব। ঢুকবেও। দরজা বন্ধ করে ড্রয়িং রুমের দিকে হাত দেখাব। দ্বিতীয়বার যখন জিজ্ঞেস করবে, "কে আপনি, ঠিক করে বলুন কী চান? রুবি কোথায় আমার রুবি কোথায়?" "আমার রুবি!! আমার?!! হা হা হা হা!! আমার রুবি!!" তারপর শীতল চোখে তাকিয়ে বলব "আমি তোর যম।" বলে এক পা এক পা করে এগোতে থাকব। খুনী ভয় পেয়ে পিছোতে থাকবে, আত্মরক্ষার উপায় খুঁজবে। এমন সময় রুবি হঠাৎ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসবে। খুনী হতভম্ব হয়ে যাবে। আমরা হেসে উঠব। রুবি বলবে "চা করেছি খাবে এসো।" আমি বলব "শুধু চা?"। রুবি বলবে "না না সঙ্গে কাবাবও করেছি। মাংসের।" আমি মনে মনে ভাবব, যাক ডাক্তারের বডিটার একটা সদগতি হল। নষ্ট করা এমনিও আমার ভালো লাগে না। মৃত্যুর সঠিক বয়স শূন্য থেকে অনন্ত। মৃত্যুশোকও তাই। ভ্রমণের গল্প হল মানুষের সাথে দেখা হবার গল্প। মানুষ আর তাদের অযাচিত ভালোবাসার গল্প। সেই পস্কো অত্যাচারিত গোভিন্দপুর গ্রামের বৃদ্ধা মহিলার কথা আমার মনে পড়ে, যিনি হাসি মুখে নিজের গায়ে ছররা গুলির ক্ষত দেখাবার পর বলেছিলেন তার বাড়ি থেকে কিছুতেই না খেয়ে যেতে দেবেননা। আমার মনে পড়ে গোপেন চন্দ্র শর্মার কথা যার সাথে মুর্শিদাবাদের সীমান্তে সীমান্তে ঘুরে মানুষের গল্প শুনেছি। আমার ঠাকুর্দার বাবা তার ছেলেবেলায় মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় চলে আসেন। তারপর আর কখনো ফিরে যাননি। তার সেই গ্রামের বাড়ি আমি দেখিনি। গোপেনদা আমায় বলেছিলেন একদিন সেই গ্রামের বাড়ি খুঁজে বের করবেন আমার সাথে বেরিয়ে। চীনের সেই বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীর ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে এখনো আমার কাছে একটি লাল সুতো রয়ে গেছে। তাঁর ভাষা আমি বুঝিনি। শুধু বুঝেছিলাম ভাষা বড় ব্যবধান নয়। আমার কাছে ভ্রমণ মানে তাই চীনের প্রাচীর, পারির আইফেল টাওয়ার বা তাজমহল নয়। তা হল আইফেল টাওয়ারের নিচে দেখা হওয়া বিন আহমেদ খানের গল্প, হিমাচলে হঠাৎ দেখা হওয়া কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এহসান-উল-হকের সাথে আলাপ, চীনের ফুটপাতে বসে মদ খেতে খেতে মাজিদ কারিমির কাছে শোনা কুর্দিস্তানের কিসসা। প্রায়শই মনে হয় তাদের সাথে যদি আবার দেখা হত। কিন্তু সেই ‘আ ম্যাপ ফর স্যাটারডে’র সাংবাদিকের মত আমিও জানি সেই জায়গায় আর ফেরা যাবেনা। ওই ভ্রমণগুলো আর নেই। কারণ সেই মানুষগুলো ওই ভ্রমণের থেকে এগিয়ে গেছে। শুধু সে ভ্রমণের গল্পগুলো রয়ে গেছে। মারিয়া সুচোউ তে এসে প্রথমেই আমার বন্ধুত্ব হয় এখানকার পাকিস্তানিদের সাথে। তাদের ভাষা আমি জানি, তাদের, গান সংস্কৃতি সবই নিজের মনে হয়। তখনো কোন ভারতীয় এখানে আসেনি। পাশের ঘর থেকে যখন শুনতে পাই সুখবিন্দর এর গান, বুঝতে পারি নিজের দেশের মানুষদের কাছে আছি। এখানে আসার আগেই যোগাযোগ হয় শাহবাজের সাথে। সে খাইবার পাকতুনখোয়ার মানুষ। ভীষণ সরল সাদাসিধে। ভারতে থাকতেই একদিন সে আমায় ফোন করে বসে, " ভাইজান, প্রথমবার বিদেশ যাচ্ছি সঙ্গে থাকবেন আর দোয়া করবেন।" এসে আলাপ হয় লাহোরের জিলে হুমা মালিক, মাহিন সাদিক, ফাতিমা আর ওয়াসি শাহ এর সাথে। ওয়াসি এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। লাহোরের সবচেয়ে নামি কলেজের গ্রাজুয়েট। রোগা ছিপছিপে চেহারা, অদ্ভুত সুন্দর ইংরেজি উচ্চারণ। পাকিস্তানের এলিট গোষ্ঠীর ছাপ মারা বিজ্ঞাপন যাকে বলে। কিছুদিন পরে এসে হাজির হয় লাহোরেরই পাকিস্তান সরকারের কর্মচারী শাহজাদ। টিপিকাল পাঞ্জাবীদের মত সে। মনের দিক থেকে ভালো অথচ মুখের আগল নেই। প্রথম আলাপেই আপনি একে অপছন্দ করবেন। পছন্দ করতে করতে দেখবেন কোর্স খতম হয়ে গেছে। এদের মধ্যে ওয়াসি আর ফাতিমা বাদে বাকিরা সবাই সুন্নি। ওয়াসি ও ফাতিমা শিয়া। আমাদের উল্টোদিকের ঘরেই পাকিস্তানি ছেলেদের বাসস্থান। সেখানে তিনজন পাকিস্তানি থাকে। আর থাকে কাজাখস্তানের আরিস্তান, তাজিকিস্তানের সোহা বা শোখরুখ আশরাফী আর উজবেকিস্তানের মারুফজান। সেন্ট্রাল এশিয়ার এই মানুষগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে নরম মনের এবং মার্জিত ব্যবহারের মানুষ। পাকিস্তানিদের উচ্চস্বরে গান বাজনা এদের জীবন হারাম করে ছেড়ে দেয়। সোহা একদিন আমায় এসে বলে "ভাই আমার এই গান এর গুঁতো আর সহ্য হচ্ছে না, তোমাদের ঘরে একটু জায়গা হবে।" আসার পর থেকেই দেখতে পাই প্রতিদিন বিকেলে পাকিস্তানিদের ঘরে হাঁহাঁ করে গান চলছে। বেশিরভাগ দিনই তা হল আমাদের বলিউডের হিন্দি গান। ওয়াসি দারুণ মিশুকে ছেলে। মাঝেমাঝেই আমার ঘরে চলে আসে। কখনো একসাথে মদ খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে বসে। আমি বলি " তোমাদের ধর্মে মদ খাওয়ায় মানা নেই?" ওয়াসি উত্তরে বলে " আল্লাহর কাছে পৌঁছনোর কি একটাই পথ ভাই? মদে মন যে উজাড় হয়ে যায়, জাগতিক সবকিছুর থেকে যে মন সরে যায় তা কি আল্লাহর কাছে পৌঁছনো নয়?" এক সপ্তাহ হয়ে গেছে এই নতুন শহরে। ওয়াসি ততদিনে খুব ঘনিষ্ঠ। একদিন আমায় পাকিস্তানি মেয়েদের ঘরে নিমন্ত্রণ করে বসে। পাকিস্তানীরা তাদের নানাবিধ খাবার বানিয়েছে। রুটি, রাজমার তরকারি আর নরম নরম বিফ কাবাব। আমি, হুমা, মাহিন, ফাতিমা আর ওয়াসি বসে, এমন সময় একটা চশমা পরা কালো চুলের ছিপছিপে মেয়ে দরজায় এসে দাঁড়ায়। তাকে আমি আগে কখনো দেখিনি। সে হলো মারিয়া, আর্জেন্টিনার মেয়ে। এই দেশের নাম শুনে আমি ততক্ষণে ভেতরে ভেতরে উচ্ছ্বসিত হয়ে গেছি। আমার মনে পড়ে যাচ্ছে বাবার সাথে বসে খুব ছোট বয়সে রাত জেগে খেলা দেখছি। ফুটবল কিছুই বুঝি না তখন। শুধু একটা ভালোবাসা বুকের ভেতর ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে। প্রতিটা চিৎকারের সাথে। নীল সাদা রং এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা হাসিমুখের সূর্যের দিকে তাকিয়ে নিজের আর একটা দেশ খুঁজে পাচ্ছি। সেদেশের কালো চুলের যুবকরা এগিয়ে যাচ্ছে গোলপোস্টের দিকে আর আমার মনে হচ্ছে আমার একটা দেশ তৈরি হচ্ছে সম্পূর্ণ অন্য এক গোলার্ধে। আমার বাসস্থান থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। আমি বিস্মিত হয়ে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। " এ তবে সেই দেশের মেয়ে।" যে দেশের মানুষ হল আমায় যে ভ্রমণ শিখিয়েছে সেই চে গুয়েভারা। যে আমায় বুঝিয়েছে বিপ্লব শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় নয় সেই ল্যাটিন আমেরিকার মানুষ আমার সামনে! সেদিন আমার মারিয়ার সাথে প্রথম পরিচয়। খাওয়া দাওয়া হলে ওয়াসি দাবি করতে থাকে সকলকে তাদের ভাষায় গান গাইবার জন্য। আমি গাই বাংলা ভাষায় একটি গান, মারিয়া আমাদের স্প্যানিশে গান গেয়ে শোনায়। আমাদের কোর্সের সকল ছাত্রছাত্রীকে একসাথে বসে কোন টপিক নিয়ে আলোচনা করতে হতো। এটা কোর্সের অংশ। প্রথম দিন আলোচনায় যখন আমি সমীর আমিন এর কথা আলোচনা করছি সেই সময় দেখতে পাই একটি মেয়ে আমার দিকে উচ্ছ্বসিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখের খুশি আমি ছুঁতে পারি। সে হল মারিয়া। প্রেজেন্টেশনের পর আমাদের দীর্ঘ গল্প হয়। জানতে পারি ইমানুয়েল ওয়ালেরস্তাইন এর সাথে কনফারেন্স করে এসেছে এসেছে সে। আমার মতই ওয়ার্ল্ড সিস্টেম থিওরির বড় অনুরাগী। আর্জেন্টিনায় তখন দক্ষিণপন্থী সরকার। মাথায় কমিউনিস্টদের লাল তারার টুপি পড়ে এসেছিল বলে তাকে কিভাবে আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয় সে দেশে জানতে পারি। মারিয়া সারা পৃথিবী ঘোরা মেয়ে। ব্রাজিলে সে বহু বছর কাটিয়েছে। ইউরোপে গেছে সাথে খুব অল্প পয়সাকড়ি নিয়ে। রাতবিরেতে ফুটপাতে দিন কাটিয়েছে। ভবঘুরের মত জীবন কাটাতে কাটাতে পৃথিবীকে অনেকটা চিনেছে এভাবে। মাঝেমাঝেই মারিয়া আর আমার গল্প হয় বসে। তার কাছে আমি জানতে পারি আর্জেন্টিনার কলোনাইজেশন এর ইতিহাস। সে জানায় " আর্জেন্টিনায় কোন আদিবাসীদের আর তুমি দেখতেই পাবে না। তারা আর নেই। কেন জানো? স্প্যানিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের প্রত্যেককে একে একে খুন করেছে। প্রত্যেককে।" আমি দেখতে পাই মারিয়ার চোখের কোনা ভিজে আসছে জলে। আমি, মারিয়া আর ব্রাজিলের রিকার্ডো বসে একসাথে ছবি দেখি। মোটরসাইকেল ডাইরিস। ছবির শেষে রিকার্ডো ইউটিউবে গান চালায়। গান বলে ' ল্যাটিন আমেরিকা একসাথে। আমাদের পাহাড়, জঙ্গল, স্বপ্ন, তুমি কখনো কিনতে পারবে না।' মারিয়া কখনো-সখনো চলে আসে আমাদের ডর্মে এক বোতল ওয়াইন নিয়ে। আমরা গল্প করেই যাই। তার চোখে দেখতে পাই দিনবদলের স্বপ্ন। আমার ছোটবেলার সেই পতাকার কথা মনে পরতে থাকে। মারিয়া আমি আর ইংল্যান্ডের অনু একবার যাই অ্যাভেঞ্জার্স এন্ডগেম দেখতে। হলে মুভি শুরু হয়েছে, আমার পাশে বসে কানে কানে মারিয়া বলে সে কখনো অ্যাভেঞ্জার্স দেখেনি, আমি যেন তাকে আগের গল্প গুলো একটু বলে দিই, ফিল্ম শেষ হয়ে গেলে। আমি তো হতবাক! বলি " তবে তুমি এলে কেন!" সে মিষ্টি হেসে বলে " তোমাদের সাথে ঘোরার জন্য"। এই মেয়ে একা একা ফাস্ট ট্রেন ধরে চলে যায় মাও জেদং এর জন্মস্থান দেখতে। সাংহাইয়ে কমিউনিস্ট পার্টির মিউজিয়াম দেখে তার চোখ চকচক করে ওঠে আমায় সেই ঘোরার গল্প বলার সময়। আমি তাকে মাও জেদং এর একটা ছোট্ট ব্যাজ উপহার দি। সে আমার জন্য এনে দেয় আর্জেন্টিনার নীল সাদা পতাকার ব্যাজ। আমার মাঝে মাঝেই মনে পড়ে তাকে। এখন সে আর্জেন্টিনাতে বসে। প্রায় ১০ মাসের ওপর আমাদের দেখা নেই। আমার স্মৃতিতে তবু রয়ে গেছে; একদিন ক্লাসরুমে নাইজেরিয়ার মার্টিন মারিয়াকে বলছে, " এই মারিয়া, অভিষেক তোমার কে?" আর মারিয়া মিষ্টি করে শান্ত হেসে আলতো নরম গলায় বলছে " কমরেড"। আন্দ্রে কিসেনকো সুচোউ শহরে কোন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট নেই। এখানে পৌঁছাতে গেলে আপনাকে আসতে হবে পাশের শহর সাংহাইতে। সেখানে দু'টি এয়ারপোর্ট। ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট মূলত আসে পুদং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। আমি ভারত থেকে আসা-কালীন আমার সাথে যোগাযোগ করে কোস্টারিকার মেয়ে গ্যাবি, একসাথে পুদং থেকে সুচোউ আসার জন্য। আমি পুদং এ পৌঁছে গ্যাবির জন্য অপেক্ষা করতে করতে, ব্রাশ করে, চোখে মুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হচ্ছি, হঠাৎ দেখি এক চৈনিক মেয়ে আমার দিকে হাত নাড়ছে। আমি তো হতবাক! সবে এদেশে পৌঁছলাম আর কেউ আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে! নির্ঘাত ভুল করছে ভেবে কাছে যাই, দেখি এ আদতে কোস্টারিকার গ্যাব্রিয়েলা বটে। কোস্টারিকায় এক বিশাল সংখ্যক চৈনিক বংশোদ্ভূত মানুষ আছে। গ্যাব্রিয়েলা তারই অংশ। সেই কোন আদিম যুগে, গ্যাব্রিয়েলার পূর্বপুরুষ হাতে হাত ধরে এই সুদূর এশিয়া থেকে পাড়ি দিয়েছিল ল্যাটিন আমেরিকায় নতুন জীবনের আশায়। তারা শুধু গ্যাব্রিয়েলার নয়, বোধহয় আমাদের মত সকল ভবঘুরেরই পূর্বপুরুষ। আজ আর তারা নেই। শুধু গ্যাব্রিয়েলার মুখের ছাপে তাদের ভ্রমণের ছবি চিরস্থায়ী ভাবে রেখে দিয়ে গেছেন। গ্যাবি অল্পবিস্তর চীনে ভাষা জানে। তার সাথে এগোতে এগোতে আমরা পুদং এর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছোই। সুচোউ শহরে নেমে যখন ডরমিটরিতে যাবার জন্য ট্যাক্সি ধরছি, দেখি একটা কালো গাড়ি এসে নিজেকে ট্যাক্সির পরিচয় দিচ্ছে। চীনে এর আগে আসার দরুন আমার জানা ছিল ট্যাক্সি দেখতে কেমন। গ্যাব্রিয়েলা তা জানেনা, ফলে তার জোরাজুরিতে যখন সেই ট্যাক্সিতে করে ডরমিটরিতে পৌঁছচ্ছি, দেখি 30 ইউয়ানের যাত্রার ভাড়া ড্রাইভার একশ ইউয়ান চাইছে! সারা সকালের জার্নির কষ্ট নিয়ে ঢুকেছি ডরমেটরির নতুন ঘরে। ছোট্ট একটা শোবার ঘর। খাটে উঠতে গেলে তার পাশে লাগানো ছোট সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। কারণ খাটের নিচেই একটা বড় আলমারি। ছোট টেবিল-চেয়ার রাখা। পাশে একটা বারান্দা। এবং ঘর থেকে বেরোনো রাস্তায় বাঁ পাশে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অ্যাটাচড বাথরুম। শোবার ঘরটা ব্যক্তিগত। কিন্তু বাইরের বসার ঘর তথা রান্নাঘর আপনাকে ভাগ করে নিতে হবে আপনার 4 ডরমিটরির বন্ধুর সাথে। আমি ঘরে ঢুকছি, পাশের ঘর থেকে এক সোনালি চুলের সাদা ধবধবে ছেলে এসে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। 'হ্যালো' ছাড়া তার মুখ থেকে কোন কথা শুনি না। স্নান করে বেরচ্ছি খেতে, দরজা খোলার আওয়াজ শুনে দেখি সেই ছেলে আবার বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কোন কথা নেই তার। একটু কনফিউজড হাসি হাসি মুখে' হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে সে। আমি বুঝতে পারছি না কি বলা উচিত। নাম জিজ্ঞেস করায় সে বলে, " আন্দ্রে। আমি সাইবেরিয়ার মানুষ।" তারপর হপ্তা-খানেক হতে চলল। বাকি ডরমেটরির বন্ধুরা তখনো আসেনি। আমি আর আন্দ্রে ডরমিটরিতে একা। যখনই কোন খুট করে আওয়াজ হয় কোথাও থেকে, দেখি আন্দ্রে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেই এক হাসিমুখ। কিন্তু কোন বক্তব্য নেই। কথা বলতে গেলে দেখি, চুপচাপ মাথা নাড়ছে। একবর্ণ বোঝে কিনা সন্দেহ হয়। অথবা ভাবি, এ সাদাকালোর বিরোধ নাকি! হয়তো সে কথা বলতে চায় না। পাশের ঘরের ওয়াসি হায়দার শাহ একদিন জানায়, " গল্প করবে কি করে? ও তো ইংরেজি জানে না।" আমি তো তাজ্জব! গোটা কোর্স ইংরেজিতে এদিকে এ ছোঁড়া নাকি সেই ভাষাই জানেনা! ওয়াসি বলে "ওর বাবা এসেছিল বেইজিং থেকে ওকে এখানে ছাড়তে। তিনি ওখানকার এমব্যাসির বড় পোস্টে কাজ করেন। আমাদের বলেছেন যেন ওকে একটু আগলে রাখি।" দেখা যায় আন্দ্রেকে আগলে রাখা ছাড়া উপায় নেই। একদিন আমি আর সোহা ইউনিভার্সিটি থেকে হেঁটে হেঁটে ফিরছি দেখি আন্দ্রে গোটা এরিয়াটা চক্কর কাটছে। আমাদের দেখে সে আবার বিভ্রান্ত হাসিমুখে তাকায়। পূর্ব সোভিয়েতের অংশ হবার দরুন তাজিকিস্তানি সোহা রাশিয়ান জানে। সে আন্দ্রেকে জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, বেচারা ইউনিভার্সিটি থেকে দু কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ডরমিটরি আসতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে! আন্দ্রের সাথে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব হচ্ছে। ততদিনে আমাদের ডরমিটরিতে এসে গেছে নাইজেরিয়ার মার্টিন। সে দারুণ মিশুকে ছেলে। আর আছে একদম চুপচাপ কোন কথা না বলা দক্ষিণ কোরিয়ার কিম। আন্দ্রে তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে আমাদের সাথে গল্পগুজবের চেষ্টা করে। মার্টিন জিজ্ঞেস করে একদিন, " আন্দ্রে, সত্যি কথা বলো তো। তোমার আমাদের ব্যাচের কোন মেয়েকে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে"। আন্দ্রে লাজুক হয়ে না না বলছে, মার্টিন তাকে জানায় এ হল ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলা। আন্দ্রে না বললে তাকে শাস্তি পেতে হবে। আন্দ্রে আমাদের দিয়ে প্রতিজ্ঞা করায় যেন বলার পর সেই গুপ্ত রহস্য আমরা কোনদিনও কাউকে না বলি। আশ্বাস পেয়ে সে জানায়, " প্রতিটা মেয়েকে"! আমি একা ঘুরে বেড়ানোর লোক। লোকজন নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর ঝক্কি আমার পোষায় না। নতুন শহরে এসে দেখি সবার ঘোরার শখ। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে প্রথমবার এই সুবিশাল চীন দেশে। কিন্তু ঘোরা তাদের কাছে কার্নিভালের মত। তারা চায় প্রচুর মানুষের সাথে হৈ-হল্লা করে শহর চিনবে। আমায় পেলেই চেপে ধরে। "সঙ্গে নিয়ে চলো"। এভাবে একদিন বেরিয়েছি তিন মহান ব্যক্তির সাথে। জিলে হুমা মালিক, তামিল সেলভান এবং আন্দ্রে কিসেনকো। চীনের বেশিরভাগ শহরে রয়েছে তাদের নিজস্ব দেয়াল। এ চীন সংস্কৃতির অঙ্গ। শিয়ানে গিয়ে দেখেছি তাদের বিশাল প্রাচীর শহরকে ঘিরে রেখেছে। কেউ হয়তো চীনের বিখ্যাত গ্রেট ওয়ালের সমকক্ষ নয়, তবু সেই প্রাচীরের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপনি বুঝতে পারেন শিআনের প্রাচীন নগরী জেগে আছে এখনো প্রাচীরের বেষ্টনীর ভেতর, আর প্রাচীর এর বাইরে নতুন প্রজন্মের চীন দেশ সেই প্রাচীন নগরীর দিকে উঁকি মারছে। সুচোউ শহরের প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে সেখানেও রয়ে গেছে একটি আধভাঙ্গা দেয়াল। এর নাম সিয়াং মেন। আমি বহুবার বিকেলবেলা সেই দেওয়ালের ওপর উঠে বসে থাকি কালো বিয়ারের ক্যান হাতে নিয়ে। বসে দেখি প্রাচীন চীনের সেই প্রাচীর কিভাবে মেলবন্ধন ঘটিয়ে চলেছে উল্টো ফুটপাতে দাঁড়ানো বিশাল বহুতল নিয়ে। প্রাচীরের পাশ দিয়ে বয়ে যায় সুচোউর বিখ্যাত ক্যানাল। রাতে সেই প্রাচীরের গায়ে জ্বলে ওঠে সাদা হলুদ আলো। প্রাচীরের গায়ে লেগে থাকা গাছের পাতার রঙে তা সবুজ হয়ে ওঠে। আমি সে প্রাচীরে বহুবার গিয়েছি। বাকি তিনজন প্রথমবার। তাদের প্রাচীর দেখার সময় দিয়ে আমি তখন সামনের পিং জিয়াং স্ট্রিটের খাবারের দোকানগুলোর ধারে। তাদের বলেছি প্রাচীরের ধার ঘেঁষে যে ফুটপাত চলেছে তা ধরে একদম সোজা এক কিলোমিটার হাঁটলেই আমার দেখা পাবে। দোকানগুলোয় ঘুরছি, এমতাবস্থায় জিলে হুমার ফোন " আপনি কোথায়? আমরা খুঁজে পাচ্ছিনা।" তাদের বলি সোজা এগোতে। তারা পাখি পড়ার মতো বলে যায় " খুঁজে পাচ্ছিনা"। আমি আবার উল্টো দিকে এগোচ্ছি। ভাবছি সত্যিই বুঝি রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছে। ২০০ মিটার পেরোই, ৫০০ মিটার পেরোই, ৭০০ মিটার পেরোই: তাদের কোনো চিহ্ন নেই! ভাবছি এগোতে এগোতে তাদের পাশ থেকে আরো দূরে চলে গেলাম কিনা, দেখি তিনজনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠিক সেই প্রাচীর এর সামনে! আন্দ্রের মুখে অমলিন হাসি। জিলে হুমা ততক্ষণে বলতে শুরু করেছে তার ক্ষুধা পিপাসার কথা। তাকে নিয়ে যে দোকানে যাই, সে বলে " এসব চলবে না। ইহা সহি হালাল নয়।" নিয়ে গেছি তাকে নির্ভেজাল বিস্কুট ও জুসের দোকানে, সে বলে " বিস্কুট ও জুসে হালাল এর চিহ্ন দেওয়া নেই। আল্লাহর নাম না নিয়েই এসব তৈরি"। বুঝতে পারি সব পরিশ্রমই বাতিল। ইতোমধ্যে তামিলের হিসি পেয়ে গেছে। সে আমায় পইপই করে বলে পাবলিক টয়লেট খুঁজে দিতে। আমি তখন জিলে হুমার জন্য খুঁজছি আসলি হালাল খাবার। তামিলকে অঙ্গুলিহেলনে দেখিয়ে দিই সোজা পাবলিক টয়লেট যাবার রাস্তা। সে " ওকে, ব্রো" বলে স্মার্টলি এগিয়ে গেছে আর আমি নিয়ে যাচ্ছি জিলেকে একের পর এক রেস্তোরাঁয়, হালাল খাবারের খোঁজে, এমন সময় ঘড়ির দিকে চোখ রেখে দেখি, ঘন্টাখানেক হতে চলল চতুর্দিকে কোথাও তামিল নেই। ফোনেও তাকে পাওয়া যায় না। আমি ততক্ষণে নিশ্চিত, ভারতবর্ষের তামিল ছেলে তামিল সেলভান নির্ঘাত ভারতীয়দের মত রাস্তায় হিসি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা খেয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে ফোন করে তার নিরুদ্দেশের খবর দিতে যাব, দেখি সে হেলতে-দুলতে ফিরছে। ফিরেই সে অভিযোগের সুরে জানায় যে তার পেট ফাটার জোগাড়, সারা চত্বরে নাকি কোন পাবলিক টয়লেট নেই। আমরা একসাথে রাস্তা পার হই আর দেখতে পাই নিয়ন আলোয় জ্বলজ্বল করছে পাবলিক টয়লেটের সাইন ঠিক উল্টো ফুটে! তামিল টয়লেট থেকে বেরোয়নি তখনও, আন্দ্রে বলতে থাকে যে সে এই মুহূর্তে ডরমিটরি ফেরত যেতে চায়। তাকে আমরা বোঝাই " একসাথে বেরিয়েছি, একসাথে ফিরব"।ভাষার সমস্যার কারণে কিনা জানিনা, সে শুধু বলতে থাকে " অন্ধকার হয়ে গেছে"। সে দাবি করে একা ফিরে যাওয়ার। ইউনিভার্সিটি থেকে ডরমেটরির পথে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে একা ফিরতে দেওয়ার মতো দৃঢ়তা আমার চরিত্রে নেই। তিনজনকে বাসে তুলে দেবো বলে দাঁড়িয়ে আছি, আন্দ্রে এসে আমার কাঁধে হাত রাখে, বলে " আমার নাম্বারটা রাখো, রাস্তাঘাটে কোন বিপদ হলে ফোন করবে। ভয় পাবে না। আমি আছি!" সে আশ্বাস দেয়। সেই নম্বর নিয়ে আমি হতভম্বের মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি আর দেখছি জানলা দিয়ে আন্দ্রে, জিলে আর তামিল আমায় টাটা করছে। বলা বাহুল্য এ ঘটনার পর আমার এবং আন্দ্রের একসাথে বেড়াতে যাওয়ার গল্পের ইতি ঘটে যায়। আন্দ্রেকে কোনদিনও কোথাও বেড়াতেও যেতে দেখি না। শুধু মাঝে মাঝে রাশিয়ানদের সাথে সে বাইরে বের হয়। তাও ন'মাসে ছয় মাসে একবার। প্যানডেমিক হয়েছে। ঘরে সকলকে বন্দী হয়ে থাকতে বলা হয়েছে। চতুর্দিক লকডাউন। আমরা মোটামুটি বাপের জন্মে না দেখা এ জিনিসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে, ঘর বন্দী হয়ে বসে কাঁপছি। এমন সময় দেখি জীবনে প্রথমবার আন্দ্রের চীন দেশ দেখার শখ হল। কেউ বেরোয় না, তাই সে একা একা বেরোয়। বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে, জানালা দিয়ে দেখি, আন্দ্রে পৃথিবী উদ্ধার করতে চলেছে। ডরমিটরিতে ফিরে সে মাঝেমাঝেই হাঁচতে থাকে। আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপ করে শুধু বসে থাকি। প্যানডেমিক যখন তুঙ্গে সে আমার ঘরে কড়া নেড়ে হাসতে হাসতে জানায় যে সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। আমি তাকে বলি টেস্ট করাতে। সে জানায় তার ইচ্ছে নেই। আমার মনে হতে থাকে ডরমিটরি থেকে সম্ভবত এই প্যানডেমিক এর সময় খোলা রাস্তা আমার জন্য বেশি সুরক্ষিত। তার বাবা বেইজিংয়ে বসে। লোকজন জল্পনা করে "এই প্যান্ডেমিকেও ছেলেকে কাছে নিয়ে গিয়ে রাখছেন না কেন?" আমি তার বাবার মনের সাথে একাত্ম হতে পারি, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি "আন্দ্রের মত একটা ছেলে থাকলে, হয়তো আমিও..." সকলে এই কথার ওজন বোঝে এবং গম্ভীর হয়ে সম্মতি জানায়। এভাবে তার পূর্বে করা স্বীকারোক্তি অনুসারে আন্দ্রে ' ব্যাচের প্রতিটি মেয়ের' প্রেমে পড়তে থাকে। এত সৎ স্বীকারোক্তি আমার আগে দেখা ছিল না। ফলে হতভম্ব হয়ে থাকি। দেখি আমাদের জুনিয়ার কলকাতার দিশা ডরমিটরিতে দেখা করতে এলে আন্দ্রে বেরিয়ে আসে নিজের রুম থেকে এবং ভাষা না জানা দরুন আমাদের দুজনের মাঝে বসে, জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে দিশার মুখের দিকে। সোহা বলে তার প্রেমিকার অফিসের সামনের চেয়ারে আন্দ্রে সকাল থেকে গিয়ে বসে থাকে। কোন কথা নেই। মুখে শুধু অমলিন হাসি। সোহার প্রেমিকার হাড় হিম হয়ে আসে। আমি কোথাও বেড়াতে যাব ( মূলত প্যানডেমিক এর সময় আন্দ্রের হাত থেকে একটু সুরক্ষিত বোধ করার জন্য) দেখি দরজার সামনে সে দাঁড়িয়ে। বলে সঙ্গে যাবে। মিথ্যে বলে একটু বেড়িয়েছি, ফেরার পথে দেখি সে জানলা দিয়ে নজর রাখছে। ঘরে ঢোকা মাত্র হাসি মিশ্রিত ভৎসনার চোখে তাকাচ্ছে। আমি ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকে যাই। অবশেষে আন্দ্রে রাশিয়া ফেরত যাচ্ছে। আমি সুখী, শেষ পর্যন্ত এই ভয়ের জীবন থেকে নিজেকে মুক্ত ভেবে। দু'দিন পরেই দেখি উই চ্যাটে আন্দ্রের মেসেজ " ইন্ডিয়াতে প্রচুর কেস বাড়ছে, তুমি সুস্থ তো?" গত দু'বছর চীন ছেড়ে কোথাও যায়নি। দুদিন আগে অব্দি আন্দ্রে তা জানে। ইন্ডিয়ার কেস বাড়ার সাথে আমার সুস্থতার কি সম্পর্ক তার লজিক্যাল কানেকশন না করতে পেরে উত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকি। তারপর সকাল থেকে দেখি মেসেজ আসতে থাকে ডরমিটরির সকলের। তারা জানায় আন্দ্রে তাদের ফোন করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে আমার খবর জানার জন্য। মার্টিন, ইমানুয়েল, লিলি, জিলে, মাজীদ হ্যানো কেউ নেই যে আমায় বলে না "আন্দ্রে র তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন, এখুনি কল করো।" মার্টিন এসে আমায় বোঝায় ভয়ঙ্কর প্রয়োজনীয়তা না থাকলে কেউ এতবার মানুষকে বলে না যোগাযোগ করিয়ে দিতে, "অভিষেক, প্লিজ বন্ধুত্বের খাতিরে একটা কল করো"। সব জেনেও, দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা কল করতে বাধ্য হই তাকে। আন্দ্রে বলে " মস্কো পৌঁছে গেছি। তুমি কেমন আছো? একটুকু জানবার জন্যই সকলকে কল করছিলাম"। আমি শান্তভাবে আন্দ্রেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। Kitchenware Chithira Kusuman In my house, apart from me, there are many other entities bearing my name. Big and small lunch boxes, a bronze cauldron, a deep fry pot, ears missing, a water pot, a rice barrel, five of six porcelain plates, three aluminium and steel pots of various sizes…..et cetra In my house when I am there or not sometimes in the sink sometimes on the slab in different racks in a row upside down wet dry full empty keep clanging poems with my name etched on them. Valley Shaju VV It was one of the mountains on both sides of the valley, lost in each other like meditating statues, that vanished first. (that picturesque valley was the table between them.) Finding a mountain disappear in a flash even as he watched, a shepherd named Anvar swooned. Three boys catching fish in the lake flailed like fish caught in the hook when they witnessed one of the snow clad pine trees, frozen in the click of of a camera wizard in the midst of a long march, vanish with a suppressed scream. The usual migratory bird often seen on the minaret of the mosque (that had forgotten its own behavior on reaching the valley) flew off grumbling that it will never return. It was in front of the dead child that the old man selling hash, who used to declare time and again that the army is disciplined insanity marching in rhythmic strides, vanished. When she saw the stream of sheep flowing down the hill vanishing like in the poem ‘how a river vanishes’, the girl named Haseena screamed in fright that she had gone blind. People, trees, birds, the constellation like a tamed animal that bloomed bright in the sky above the valley every night, towns, vehicles, villages, roads, snow bears, concepts, memories, dreams, scents, tastes, pathways like the nerves in the brain, words uttered by the people, words scribed on books, evenings tinted with sadness, feelings of anguish that became things of the past, thus, from that nation, day by day, many people many things vanished. In each and every map, that nation was seen rotting and infested with worms. The pain of losing everything that one loved settled down in that valley. The few remaining wondered where all of them vanished. Eventually, they too vanished. How can we call them refugees, the people who vanish with no destination, leaving no signs of themselves? Much later, that nation, where only the army and the shepherds grazing them remained, came to be known as the putrid corpse of paradise. Mermaid Subin Ambitharayil Once, in a dream, I had to traverse on foot a sea seething with fish. Though I walked far, though it was a dream, I did not come across any mermaid. The schools of fish swam thick and sang while gulping down food. I felt like saying Hi to them. But, they did not mind me even with the swish of a tail. I felt irritated. I let float a troll ‘how thrilling is their life till trawled by a net!’ They cannot fool around with me who can troll even someone’s death. Wasting not the opportunity that came free of cost, I roamed around all corners of the sea searching for the wreckage of the Titanic. Apart from wasting my time, I could not find the Titanic. I found relief in the thought that the time of my dreaming might have been before the Titanic was wrecked and that there could be no dream that travelled alongside life. It was one expanse of a dream that spread like the sea to the far distance and down to great depths. Though I was in water the whole time, I had no difficulty in breathing. I assumed that there is no need for oxygen to dream. If that is so, there won’t be any break in dreaming even after death, I happily thought. I even felt like writing a poem about the dreams the dead ones have. After walking for long I crawled up the shore of the dream about to end. She was sleeping beside unmindful of all this. Like always, I thought then. What a pretty sight is a woman’s slumber! Calling out to her, “O my mermaid!” I planted a kiss, lip-locked. No, the lingering scent of last night’s fish curry was yet to leave her lips. I felt hungry again. Room of the believer Samudra Neelima Long vacation. The beginning of summer. When you took time returning from your home town some of us joked that you were exiled by the state. I laughed with them. One day, you called. Asked me to send you the id card you had left behind in your room. I opened your room. but, could not find the card. I sat for some time in your room wondering how to go about it. The room was cooler than elsewhere. Your holy book bound in green lay on your table. I slipped into a nap for some time secured by the coolness of the marble floor. I woke up hearing the muezzin’s call to prayer. I was startled as if it had dawned. Why had I not ever heard that call living right next door? Prayer is more valuable than slumber. I felt that prayer was also resistance. The modulations of that voice echoed from the minarets of the setting sky. I shut her room and threw a glance inside through the window. I felt that the room was brilliantly lit up inside, luminescent and glowing. I did not feel like returning to my own room. Guerilla warfare Rajesh Chithira First, the newspaper. One can live without the news, isn’t it so? Then, the milk vender. One can live without milk, Isn’t it so? A solution to everything. We are safe in our homes, Aren’t we? Stocked up for one month. Not consumed even in three months. We should not strain our body. The illness catches you where there is strain. Started sleeping in two different rooms. One could live without seeing each other, Isn’t it? One could sleep without hugging each other, Isn’t it? There is a solution to everything. Shashankan’s travails. Vipitha Shashankan frequently suffered from indigestion and itching. Women, like the royal characters in the dubbed Hindi serials are not pronouncing the word ‘breasts’, but get a kick from calling them ‘boobs’ or ‘boobies!’ Boobs in stories Boobs in poems Boobs in the streets Boobs in streetcars. Women do very many things with the thing for breastfeeding. Women are not women like before. Shamelessly, they say that they have vaginas. Even if they have, can they publicize it to the people? Can they sketch and show? Can they hug other breasts? Shashankan was distraught. He burned in and out. Vagina in sketch lines. Vagina in poetry lines. Blooming in red, in black, giving birth to kids. His anger knew no bounds when watching the sun. As if the sun rose and dawns broke from the cleavage between breasts and not between mountain peaks. Shashankan screwed shut his eyes. He boycotted fruits seeing the vagina in camouflage in orange slices. He suffered. He suffered. Suffered till he became thick skinned, poor guy! Thus, unable to overcome indigestion or itching, suffering because of women, the royal character Shashankan kicked the bucket. _________ অহেতুক _________ ------------------------------------------- (১) চাঁদিয়ালের ঝাঁকে ফিরেছি রাইডাকে, লাটায়ে প্যাঁচ কাটে লাল দেওয়াল, তাই উল্কি আঁকা মেঘে পিঁপড়ে রহে জেগে, বৈতরণে জাগে রংমশাল ---- মোর নিকোনো গাঙে যারা সেঁজুতি ভাঙে তারা হয় ফকির নয় শঙ্খচিল, তাই পোড়ামাটির জিনে, নিয়নে, মসলিনে, এস্রাজিয়া হবে ইসরাফিল ---- হায়, এঁটো চাঁদের বীজে, আরীজে, পিলসুজে, নিভিলে বারোয়ারি মনবানুষ, সই অঙ্গ বিভাবরে বেঁধো ছুমন্তরে অশুচি একফোঁটা কালপুরুষ ।। (২) ঝঞ্ঝ পাএল জঁ অরুঝায়ল মর সুহাগঁর চিহ্নিয়া, সই, ঢরতি নাওকি পহিল ডাহুকি পুহপ তহ্নিক পাসিআ ---- তৌঁ বজর তুয় জঁহ ব্রজতিখয় মেখ চঞ্চরতি চরূ নাফিসা, হায়, নিখস ফাগহি উগল তাতহি নৈনি ঋসহক জারিআ ---- মোঁই অরণে শোহন খিলত মোরন অছল ভোলহিঁ কৌসরা, সই, চন্দহাসক তুহঁ উপাসক হম পুজারুন অতসমা । বাংলা শব্দার্থ: চাঁদিয়াল-- একধরনের ঘুড়ি; রাইডাক-- রায়ডাক নদী (a river in the Himalayas); বৈতরণ-- বৈতরণী নদী; এস্রাজিয়া-- এস্রাজ বাদক; ইসরাফিল-- angel of music and armageddon (one who would blow the trumpet of apocalypse); আরীজ-- কমলাফুলের সুগন্ধ (আরবি); বিভাবর/বিভাবরী-- রাত্রি। ব্রজবুলি শব্দার্থ: ঝঞ্ঝ পাএল-- ঝড়ের পায়েল; জঁ-- যে; অরুঝায়ল-- জড়াইল; মর-- মৃত; সুহাগঁর-- সোহাগিনী; চিহ্নিয়া-- চিনিয়া; ঢরতি-- ঢলিছে; নাওকি-- নাবিক; পহিল ডাহুকি-- প্রথম হংসিনী (সাঁওতালি উপকথা অনুযায়ী মানবজাতির জন্মদাত্রী, যার নাম হাঁসিল); পুহপ-- পুষ্প; তহ্নিক-- তাহার; পাসিআ-- বাঁধিয়া; তৌঁ-- তবে; বজর-- বজ্র; তুয়-- তোর; জঁহ-- যেখানে; ব্রজতিখয়-- ব্রজের তৃষ্ণা; মেখ-- মেঘ; চঞ্চরতি-- ভ্রমরের মতো বারবার ঘুরছে বা নাচছে; চরূ-- অঞ্জলি; নাফিসা-- পবিত্র/সুন্দর/দুর্লভ (আরবি); নিখস-- নিকষ/কষ্টিপাথর; ফাগহি-- রঙে; উগল-- উদিত হইল; তাতহি-- সেই দিকেই; নৈনি ঋসহক-- হরিণের চোখ; জারিআ-- জ্বালিয়ে দিয়ে; মোঁই-- আমার; অরণে-- অরণ্যে; শোহন-- মারওয়া ঠাটের অন্তর্গত শোহিনী নামক এক রাগিণী (meant to be sung/played before sunrise); খিলত-- ফুটিছে; মোরন-- ময়ূরী; অছল-- ছিল; ভোলহিঁ-- ভোরেরই; কৌসর/কৌসরা-- lake or river of paradise (Arabic); চন্দহাসক-- তরোয়ালের; তুহঁ-- তুই/তুমি; হম-- আমি; পুজারুন-- পূজারিনী; অতসমা-- অস্তের আলো (তথাগত বুদ্ধ, one who had extinguished the flame of ego). ________ শিহাবনামা ________ ----------------------------------------------- (১) আজাদির বেনোফুল পুতুলের লজ্জায় কার কাঁখে রোজা রাখে? কার গাঙে ছলকায়? রজসী তসবী হাতে জিপসিগন্ধ মাতে, চাঁড়ালীর একতারা মিমোসা তিস্তারাতে ভিজেছে, ভেঙেছে, যেন সুজনি রাজার সুখে, আলোনা চাঁদের দেশে, মাতলা চারণ্যকে ----- তবু এ সিঁদুর মাসে তামাদি অট্টহাসে আজাদির মৌমাছি রূপকথা ফাহেশায় ইস্পাতে, রুবাইয়তে, কার নথে ঝলকায়? (২) ভৈঁরহি ভিখরনি রহসমি নৃত্যে রজস কুহুম চুমে সাঁওরি চিত্তে, গহুএ মুখরু ধনি অহিন কলঙ্কনি তমখ তঁহ্নি রতি নঅর উজারে ----- জোছন জোগন চঞ্চর সারে ----- সিঁহজন ভঙ্গহি পুছল সঁঝ নূঁ তহি রুপলহ শোঁহতি কৈসন আঁকি? মৃঘমত মঞ্জর অলতমে ঢাকি? সখিঅর হন্তি উঘল হিঅন্তি ঝিমক যৈছে তুঁঅ নিঁদএ ছুপায় ।। বাংলা শব্দার্থ: শিহাবনামা-- উল্কাকাহিনী (আরবিতে 'শিহাব' শব্দের অর্থ উল্কা বা অগ্নিশিখা); রজসী-- রজগুনপূর্ণ/রাজসিক/রজঃস্বলা; তসবী-- জপমালা (আরবি); মিমোসা-- লজ্জাবতী লতা; চাঁড়ালী-- চণ্ডালী/শূদ্রাণী; সুজনি-- একপ্রকারের নকশাদার চাদর, বা সেই চাদর বানানোর সূচিশিল্প (from the Persian word "sozni"); আলোনা-- লবণহীন; ফাহেশা-- মন্দ/ব্যভিচার/অশ্লীল (আরবি); রুবাইয়ত-- চার-পংক্তির কবিতা (ফার্সি)। ব্রজবুলি শব্দার্থ: ভৈঁরহি-- ভৈরবী; ভিখরনি-- ভিখারিনী; রহসমি-- রহস্যময়ী; রজস-- রজগুনপূর্ণ/রাজসিক/রজঃস্বলা; কুহুম-- কুসুম; সাঁওরি-- শ্যামবর্ণা; গহুএ-- গ্রহণ করিয়া; মুখরু ধনি-- আয়নার শব্দ; অহিন-- বিজুলি; কলঙ্কনি-- কলঙ্কিনী; তমখ-- তমসা; তঁহ্নি-- তাহার; নঅর-- নগর; উজারে-- উজাড় করে; জোছন-- জ্যোৎস্না; জোগন-- যোগিনী; চঞ্চর সারে-- ভ্রমরের সাড়ায়; সিঁহজন-- শিঞ্জিনী/নূপুরের শব্দ; ভঙ্গহি-- ভাঙতেই; পুছল-- জিজ্ঞাসা কর; সঁঝ নূঁ-- সন্ধ্যাকে; তহি-- তখন/তথায়; রুপলহ-- রুপোলি; শোঁহতি-- রক্ত; কৈসন-- কেমন করে; মৃঘমত-- কস্তুরী/মৃগনাভি; মঞ্জর-- মঞ্জরী; অলতমে-- আলতায়; সখিঅর-- সাইয়ারা বা নক্ষত্র (ফার্সি); হন্তি-- নিক্ষেপ করিয়া; উঘল-- উদিত হইল; হিঅন্তি-- বিলাওল ঠাটের অন্তর্গত রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরের রাগ (হেমন্ত); ঝিমক-- ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি; যৈছে-- যেমন করে; তুঁঅ-- তোর/তোমার; নিঁদএ-- নিদ্রায়; ছুপায়-- লুকোয়। [এখানে অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলি জশুয়া বোধিনেত্র-র প্রথম কবিতার বই ‘শিহাবনামা’ থেকে নেয়া হয়েছে।বইটির প্রকাশক হারাকিরি।আগ্রহী পাঠকেরা খোঁজ করতে পারেন। ]
# How to Survive a Dreadful Date with the Generous Help of Floral Accent Every girl gets called by the name ‘Pinky’ at least once in her lifetime. Every girl is presumed to blush violently once she hears the name ‘Pinky’ albeit it's not supposed to be her real name. Once a girl is summoned by the name ‘Pinky’ she ceases to be a girl and becomes a Geranium tree, stoic and expressionless, slowly dying out of boredom. And then, more often than not, the men who lead the Union pick her up by the waist and put her inside their shabby bachelor apartments for the general consideration of their second cousins. And after a trivial day or two, there come the second cousins, riding their rickety scooters, looking dilapidated as ever for no particular reason. They immediately start asking stupid questions like ‘Do Geraniums prefer the sun or the shade?’, ‘Do Geraniums come back every year?’ or ‘How do I know for sure if my Geraniums are dead?’ etcetera. They frown and minutely inspect the tiny tree hastily planted in a dusty old terra-cotta pot and after an accustomed pause or so, generally settle for saying stuff like ‘What a drunken old rascal like you is doing with such a lovely tree?’ and leave at once, stomping like crazy otters, without even caring for a sip of their much-favored masala chai. And then the disheartened Union men choose to get rid of their tree and relieve it to the nearest municipal dustbin, terra-cotta pot and all. At dusk, they come back home tumbling, dead-drunk, and sob like soft babies for the rest of the night, all the while imagining lush valleys polka dotted with countless Geranium bushes, swiftly swaying under the influence of a cool afternoon breeze. The abandoned trees, however, cease to be trees and regain their female-forms once the morning sirens from the nearby factories start ringing. Slowly, the girls pick themselves up from their pots, dusting the soil under their fingernails, and head home, plotting some lame excuse for their worried-to-death mothers. All in all, it’s not such a bad experience. #How to Fix a Faulty Marriage with the Aid of an Asylum You’ve been secretly carrying The Pine River Mental Institution inside your bosom for quite a while. Your husband doesn’t notice. He’s too busy dreaming of Santa Fey. He digs Santa Fey the way one generally digs the Beatles or Sir Arthur Conan Doyle. He can name each street and each prominent building of the former Spanish colony from his memory. When you two make love, an extremely unlikely event that is, he shuts his eyes and moans in pleasure-‘Elevation: 2,194 meters, Area: 96.9 km², Population: 83,776’. Keeping his eyes tightly shut throughout the act, he cums like a teenager, whispering the latest weather updates from New Mexico. The Pine River Mental Institution goes unnoticed. Frankly, you’ve become quite accustomed to its tiny presence. It feels like a small and fluffy animal tucked inside your cleavage. Not an unpleasant feeling after all. When dusk falls, you like the feel of putting on your favorite corset and standing on the balcony for everyone to see. Men gather under your balcony and whistle. They say you have a beautiful body. They call you by strange names. You like being called by strange names. It generates a weird kind of fondness inside your throat. Inside the house, the husband tries to decipher the mysteries of the Pueblo-style architecture under the dim rays of the Turkish lamp. Inside your skin-hugging satin lacings The Pine River Mental Institution tugs at your nipples. The more aloof your husband, the needier The Pine River Mental Institution becomes. Eventually, the men under the balcony get bored and leave for dingy pubs. For dinner you fry up sardines and sneakily tuck them inside your bosom. The husband doesn’t notice that you’ve been losing your appetite quite rapidly. He devours his portion while reading a pamphlet on The Georgia O'Keeffe Museum. The Pine River Mental Institution makes a strange purring noise. Your marriage seems to be in tune, almost photogenic, like any other marriage. The neighborhood seems peaceful at night, like any other neighborhood. Way past midnight, when the drunken men sloppily drag themselves to their ever-dissatisfied wives and the regular broils, your husband sleeps like a baby dreaming of Santo Nino Lane or Waldo Street while you, on the other end of the king-sized sleigh bed, slowly drown in your slumber, clinging to The Pine River Mental Institution like a soft toy, imagining lobotomy and electric shocks. Notes on a Poem avant-garde poetry: so so nice -- a genius blending of the light, which cannot be seen, but move like an alphin -no, too obscure …or is it all just a sham? (No, take out, this out). Take me out. Only delete those words that I use too much, like a user. (is that PC? and why does that word alone contain the connotation of excess?) <- This line is too long, yet most of what I want to say I say, stop the repetition -- but perhaps what is said instead is art instead (thinking what rhymes with that -- bed, dead, read, said, bread, head thread, wed --) or perhaps all art is repetition cleverly disguised. Like Truth. in some classical slants oh geez, don’t write like a check-list …unless, it is a check-list -love -relationships -death -ife -- (a typo that can lead into a collision of abc’s into an analogous game of God) But soft! –ly? (Too Shakespearean – but what an oxymoron) If if if the (meaning, power, merit, worth, interest, value, synonym -- ) of the poem (article needed? Speaking in plural? Do these words contain too many social connotations? Should I avoid connotations? Even the word This is not a poem II Ceci n'est pas une – I don’t speak French, I’m not even casually acquainted with it really, so it may Be. Full stop. More so, I don’t smoke -- said the man to the man, (himself) But I do know how to lie. This godwottery will only grow, can ever know the treachery of life. |