Agony Opera
  • Home । হোম
  • Blog । ব্লগ
  • Submit | লেখা পাঠাবার নিয়ম
  • Subscribe। গ্রাহক হোন
  • Home । হোম
  • Blog । ব্লগ
  • Submit | লেখা পাঠাবার নিয়ম
  • Subscribe। গ্রাহক হোন
Search

চরিত   চচ্চড়ি  (তৃতীয়  পর্ব) ।।   অভিষেক মুখোপাধ্যায়

30/11/2020

0 Comments

 
Picture



ভ্রমণের গল্প হল মানুষের সাথে দেখা হবার গল্প। মানুষ আর তাদের অযাচিত ভালোবাসার গল্প। সেই পস্কো অত্যাচারিত গোভিন্দপুর গ্রামের বৃদ্ধা মহিলার কথা আমার মনে পড়ে, যিনি হাসি মুখে নিজের গায়ে ছররা গুলির ক্ষত দেখাবার পর বলেছিলেন তার বাড়ি থেকে কিছুতেই না খেয়ে যেতে দেবেননা। আমার মনে পড়ে গোপেন চন্দ্র শর্মার কথা যার সাথে মুর্শিদাবাদের সীমান্তে সীমান্তে ঘুরে মানুষের গল্প শুনেছি। আমার ঠাকুর্দার বাবা তার ছেলেবেলায় মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় চলে আসেন। তারপর আর কখনো ফিরে যাননি। তার সেই গ্রামের বাড়ি আমি দেখিনি। গোপেনদা আমায় বলেছিলেন একদিন সেই গ্রামের বাড়ি খুঁজে বের করবেন আমার সাথে বেরিয়ে। চীনের সেই বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীর ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে এখনো আমার কাছে একটি লাল সুতো রয়ে গেছে। তাঁর ভাষা আমি বুঝিনি। শুধু বুঝেছিলাম ভাষা বড় ব্যবধান নয়। আমার কাছে ভ্রমণ মানে তাই চীনের প্রাচীর, পারির আইফেল টাওয়ার বা তাজমহল নয়। তা হল আইফেল টাওয়ারের নিচে দেখা হওয়া বিন আহমেদ খানের গল্প, হিমাচলে হঠাৎ দেখা হওয়া কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এহসান-উল-হকের সাথে আলাপ, চীনের ফুটপাতে বসে মদ খেতে খেতে মাজিদ কারিমির কাছে শোনা কুর্দিস্তানের কিসসা। প্রায়শই মনে হয় তাদের সাথে যদি আবার দেখা হত। কিন্তু সেই ‘আ ম্যাপ ফর স্যাটারডে’র সাংবাদিকের মত আমিও জানি সেই জায়গায় আর ফেরা যাবেনা। ওই ভ্রমণগুলো আর নেই। কারণ সেই মানুষগুলো ওই ভ্রমণের থেকে এগিয়ে গেছে। শুধু সে ভ্রমণের গল্পগুলো রয়ে গেছে।



আহসান উল হক

২০১৫ সালে যখন একের পর এক কনফারেন্সের দৌলতে সারা ভারত ঘুরে বেড়াচ্ছি তখন একদিন হিমাচল সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের কল ফর পেপার দেখতে পাই। আমি সে সময় ভারত ভ্রমণের এক অভিনব পন্থা বেছে নিয়েছি। যেকোনো বিষয়ের কনফারেন্স হোক, আবেদন করে দিই। থাকা-খাওয়া যাতায়াত পেলেই। হিমাচল সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি কাংড়া অঞ্চলে অবস্থিত। শুধুমাত্র এই তথ্যই আমাকে আপ্লুত করে তোলে। কাশ্মীর নিয়ে বহুদিন ধরে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি, ভাবি এই ফাঁকে রথ দেখা আর কলা বেচা উভয়ই হয়ে যাবে। তার সাথে ধর্মশালা ও ও ম্যাকলয়েড গঞ্জ এর আকর্ষণ ছিল অন্য জায়গায়। জেএনইউ তে সেন্ট্রাল এশিয়ান স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টে আমার বন্ধু সন্দীপ গবেষণা করত। তার কাছে কিভাবে যেতে হবে, কোথা থেকে টিকিট কাটবো এবং সর্বোপরি কাংড়া থেকে ধর্মশালা যাওয়ার পথ জেনে কাশ্মীরি গেট থেকে রাতের বাস ধরে রওনা হয়ে যাই কাংড়া। রাতের বাস যেহেতু সস্তা। ঘুমোতে ঘুমোতে ভোরবেলা দেখি পাহাড়ের ভেতর ভেতর দিয়ে আমাদের ঝরঝরে বাস এগিয়ে চলেছে। ইউনিভার্সিটি কোথায় সঠিকভাবে জানিও না। বাস নামিয়ে দেয় এক জায়গায়। তারপর ব্যাগ কাঁধে মানুষকে জিজ্ঞেস করে ইউনিভার্সিটির ঠিক করে দেওয়া হোটেলে পৌঁছনো। ক্লান্তিতে তখন চোখ বুজে আসছে। লোকজন একের পর এক পেপার পাঠ করছে। আর আমি ঝিমুচ্ছি।

এমন সময় আধোঘুমের মধ্যে নিজের নাম শুনে চটকা ভাঙ্গে। কে একজন দেখি (সম্ভবত সিডিউলড স্পিকার আসেনি বলে) আমার নাম ঘোষণা করে দিয়েছে বক্তা হিসেবে। এদিকে আমি জানি আমার বক্তব্য রাখার কথা পরের দিন। কোন প্রিপারেশন নেই, সারারাত বাসের ধকল আর অর্ধ ঝিমন্ত অবস্থায় আমি প্রায় টলতে টলতে স্টেজের দিকে চলে যাই। যদিও কাশ্মীর নিয়ে পূর্ববর্তী পড়াশুনো আমায় বাঁচিয়ে দেয়। বক্তব্য শেষ করেছি হঠাৎ সামনের সারির একজন ব্যক্তি (পরিষ্কারভাবে যাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বসানো হয়েছে সেখানে) এগিয়ে এসে আমায় শুভেচ্ছা জানায়। শুভেচ্ছা কার না ভালো লাগে, অত্যন্ত খুশি-মনে ভদ্রলোকের সাথে যখন কথা বলছি তিনি হঠাৎ করে বলেন " আপনি এত ভালো বলেন, এত বড় ইউনিভার্সিটির ছাত্র, আপনাদের কিন্তু একটা দায়িত্ব রয়েছে 'ওদের' মুখোশ উন্মোচন করার"। আমি মোটামুটি স্তম্ভিত তখন। তখন দেশ পুরোপুরি মোদীর ভারতে পরিণত হয়নি। বিশেষ করে অ্যাক্যাডেমিকস এর লোকজন ক্রিটিকাল চিন্তাভাবনার কদর করে। সরাসরি উন্মুক্ত ভাবে বিদ্বেষ ছড়াতে তখনো দেখতে পাইনা। আমার প্রেজেন্টেশনের টপিক ছিল কাশ্মীরের প্রাচীন ইতিহাস। সেই ইতিহাস কিভাবে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলমান এই সকল ধর্মের ধারা প্রভাবিত ও সমৃদ্ধ এটা বলতে চেয়েছিলাম। টপিক এমনকি র‍্যাডিক্যাল কিছুও নয়। বরং কালচারাল হেরিটেজ নিয়ে। প্রশ্ন করে বসি " এই 'ওদের' বলতে কার কথা বলতে চাইছেন? "ভদ্রলোক উত্তর দেন "আপনি তো জানেনই কাদের কথা। যারা কাশ্মীর দখল করে রেখেছে। কোন ধর্ম অগ্রাসনে বিশ্বাসী, দাদা"? বলতে থাকেন "জেএনইউ এর গবেষক হিসেবে আপনি এর বিরুদ্ধে লিখলে আদতে কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে। মাথায় রাখবেন। পক্ষ তো নিতেই হবে। "আমার ততক্ষণে মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। সত্যি বলতে ভারতে এই পরিবেশ তখনো আমার প্রত্যক্ষ নয়। আমি ধীরে ধীরে এড়িয়ে পিছনের সারিতে গিয়ে বসে পড়ি। তারপর দেখি একের পর এক কাশ্মীরের হিন্দু হেরিটেজ নিয়ে পেপার প্রেজেন্টেশন চলছে। অবশেষে সেই কনফারেন্সের প্রথম দিন শেষ হয়। এক ভদ্রলোক আসেন এবং হিন্দু রাষ্ট্র আসার আকাঙ্ক্ষায় আক্ষরিক অর্থে গান গেয়ে ওঠেন।

সবাই একসাথে ফিরবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক করে রাখা বাসে। কিন্তু তার আগে হবে মিটিং। এই মিটিংয়ে কি হবে জানার মত মানসিক সক্ষমতা তখন আমার নেই। আমি কোনমতে গিয়ে অপেক্ষারত বাসে উঠে বসে আছি। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে চলেছে। সেই মিটিং এর শেষ হয় না। আমি আর বাসের ড্রাইভাররা বসে বসে তখন চা খেয়েছি। তারা আমায় গল্প বলেছে কাংড়ার ইতিহাসের। বলেছি "এতক্ষণ অপেক্ষা না করে হেঁটে চলে যাই"। তারা বলেছে "আপনাকে যেতে দেব না। পাহাড়ের মানুষ ভালো। তবে সন্ধ্যে হলে এখানে অন্ধকার হয়ে যায়, আপনি নতুন মানুষ চুরি-চামারি হয়ে গেলে আমাদের কি দায়িত্ব নেই নাকি!" এইটুকু সময়, শুধুমাত্র এটুকুই সময় তখন আমার মনে হয়েছে নিঃশ্বাস নিতে পারছি।

হোটেল রুমে ফিরে দেখি সেখানে একজন রুমমেট হাজির। সে জম্মু ইউনিভার্সিটির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। কথাবার্তা শুরু হয়। এবং ভয়াবহ ভাবে দেখি সেও ওই একই হিন্দুত্বের এজেন্ডা নিয়ে হাজির। আমায় সে বলে এই গোটা কনফারেন্স অরগানাইজ করেছে দিল্লির একটি এনজিও। সেই এনজিওর মূল এজেন্ডা কাশ্মীরের হিন্দু হেরিটেজ লোকের সামনে আনা এবং ইসলামিক মৌলবাদকে কাউন্টার করা। সে বলে "আপনি বাঙালি। জেএনইউ এর গবেষক। আপনাকে সাথে পেলে অনেক দূর যাওয়া যাবে।" আমি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠি। সে বলতে থাকে কাল সে আমায় তাদের এনজিওর হেড এর সাথে আলাপ করাবে।

আমি ততক্ষণে শিহরিত। জীবনে প্রথমবার একাডেমিক প্রেজেন্টেশন করতে গিয়ে চোখে জল এসে গেছে। পন্ডিচেরি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর মোহনান পিল্লাইকে ইমেইল করে বসি। তিনি বলেন শান্ত হতে। মাকে ফোন করে সব বলে জিজ্ঞেস করি সবকিছু ছেড়ে চলে যাব কিনা। তেমন দমবন্ধ পরিবেশ এর আগে আমি কখনও প্রত্যক্ষ করিনি। মনে হচ্ছে চতুর্দিক থেকে কোথাও আটকে পড়ে গেছি। আর একজন রুমমেট আসার কথা। আতঙ্কিত হচ্ছি সে আবার কতটা হিন্দুত্ববাদী হবে, কি করে একটা রাতও কাটাতে পারব এক ঘরে! রাত হয়, দেখি এক কাশ্মীরিদের মতই দেখতে সুদর্শন ছোঁড়া পিঠে ব্যাগ হাতে ঘরে ঢুকছে। জম্মুর সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর খেতে গেছে। আমি ঘরে একা। সেই ছেলে হাসে, আমি শুকনো হেসে তাকে তার নাম জিজ্ঞেস করায় বলে "মেরা নাম হ্যায় আহসান উল হক। মে জম্মু সে হু। অউর আপ?" এই একটা নাম আমায়  সেদিন পৃথিবীর চরমতম স্বস্তি দেয়। মনে হয় অবশেষে এই পরিবেশ থেকে বাঁচার এক সুলুক সন্ধান পেলাম। এই একটা নাম। আহসান উল হক।

তখন ঘরে কেউ নেই। আমি তাকে বসিয়ে গোটা পরিস্থিতির কথা বলি, এই আন্দাজ করে যে সে নির্ঘাত হিন্দুত্ববাদী হবে না। সেই মুহূর্তে হিন্দু নামধারী কাউকে বিশ্বাস করার অবস্থায় নেই আমি। আহসান দেখি শান্ত। সে টুরিজম স্টাডির স্টুডেন্ট। লিবেরাল। খানিক গান্ধীবাদী। আমায় বলে "চলুন না এদের সাথে আলোচনা করি। দেখি এদের পয়েন্টটা কি? এমনিতেও তো কাশ্মীরে যে সন্ত্রাসবাদ চলছে তা ভালো নয়।" জম্মুর সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর খেয়ে ঘরে ফেরে। স্বভাবতই সে আহসানকে দেখে বিরক্ত। কিন্তু পাশে আহসানের বসে থাকা আমার মনে জোর এনে দেয়। তার সাথে যখন তর্ক ঝগড়ার দিকে যাচ্ছে, আহসান আমাদের দু'জনকেই বোঝাতে থাকে দু'পক্ষেরই গলতি আছে। তখন আর আমার ভয় নেই, বিরক্ত হয়ে শুয়ে পড়ি। আহসান বুঝিয়ে চলে সেই জম্মুর প্রফেসর কে। রাত হয়ে আসে। ঘুমের ঘোরেও শুনতে পাই অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর এর গলা "লক্ষ লক্ষ হিন্দু কে মেরেছে ওরা। এর ক্ষমা হয় না"।

পরদিন সকালে কনফারেন্সের দ্বিতীয় ও শেষ দিন। আমি আর আহসান একসাথে ঘুরছি। জানছি আহসান এর খুব প্রিয় বন্ধু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরিয়ে দেখায় আর বলে "নতুন ভাইস-চ্যান্সেলর আসার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ গৈরিকীকরণ হয়ে গেছে, ভাই। আমরা এভাবেই আছি, সব মেনে নিয়ে।"  আমি তাকে জিজ্ঞেস করে বসি" এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কি কোনো মুসলমান পড়াশোনা করে না?" সে ম্লান হাসে।

 বক্তব্য দিতে স্টেজে ওঠেন আহসান দের কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ভাইস-চ্যান্সেলর। আহসান তাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। বলে "ইনি অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি ভাইজান। আমরা অনেক কিছু শিখেছি এনার থেকে। এনার বক্তব্য আপনার ভালো লাগবে দেখবেন। "দেখা যায় তিনি বক্তব্য দিলেন কাশ্মীরের রাস্তার নাম সেখানকার প্রাচীন হিন্দু দার্শনিকদের নামে পরিবর্তন করতে।  মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের নাম মুছে দিতে হবে। আমি আহসানের দিকে তাকাতে পারিনা। কিন্তু যতবারই কিছু বলতে যাই, সে হাত ধরে বসিয়ে দেয় বলে" কি দরকার এসব ঝামেলার ভাই। প্রেজেন্টেশন করতে এসেছি সার্টিফিকেট নিয়ে কেটে পরি চলো।" অবশেষে আহসান উল হকের প্রেজেন্টেশনের সময় আসে। সে বক্তব্য রাখছে কাশ্মীরের ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে। সম্পূর্ণ কাঠখোট্টা ইকোনমিক্স এর বক্তব্য। বক্তব্য শেষের পর শ্রোতারা প্রশ্ন রাখছেন। হঠাৎ আমাদের জম্মুর অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর প্রশ্ন করে বসেন "সবই তো বুঝলাম, কিন্তু ট্যুরিজম কে তো প্রভাবিত করে টেরোরিজম। আপনার কি মনে হয় কিভাবে এই টেরোরিজম এর হাত থেকে ট্যুরিজম কে মুক্ত করা যাবে?" সে ব্যাটার বোধহয় ধারণা হয়েছিল, আগের দিন রাতে আহসানের গান্ধীবাদী কথাবার্তা শুনে, যে হিন্দুত্ববাদের ভালো মুসলমান মুখ হতে পারে আহসান উল হক। প্রশ্ন করে সে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। ভাব যেন “কেমন দিলাম?” আমিও হতাশ হয়ে অপেক্ষায় আহসান উল হকের ব্যালেন্স করা জবাবের। এই মুহুর্তে, খানিক বিরতির পর, আহসান উল হক বলে ওঠে "কাশ্মীরে টেরোরিজম থেকে ট্যুরিজম কে বাঁচাবার একমাত্র উপায় ----- কাশ্মীরের স্বাধীনতা।"

গোটা কনফারেন্স হলে তখন মৃত্যুপুরীর নৈঃশব্দ্য। একমাত্র আমি সজোরে তালি বাজিয়ে যাচ্ছি উঠে দাঁড়িয়ে। পাশ থেকে শুনতে পাচ্ছি জম্মুর সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর এর দাঁত কিড়মিড় সহ গোঙানি "আমাদের ওদিকে বললে শালাকে কেটে ফেলে দিতাম।" আমি শুনছি, আর সেই গোটা কনফারেন্স হলের নিস্তব্ধতার ভেতর হাসি চাপতে না পেরে অট্টহাসির দিকে চলে যাচ্ছি। 

হিমাচল সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির কনফারেন্স হল অবশেষে গমগম করে উঠছে।


তামিল সেলভান

তামিল সেলভান এর সাথে আমার আলাপ সুচোউ আসার পর। আমাদের ডিপার্টমেন্টে সে বছর চার ভারতীয়। আমি পূর্ব ভারতের মানুষ। সত্যম নেগী উত্তরাখণ্ডের ছেলে। মুম্বাইয়ের পিয়ুষ সিংহ। আর চেন্নাই থেকে তামিল। আমার প্রথমেই তামিলের সাথে বন্ধুত্ব হয়। আমার জীবনের দুটি বছর কেটেছে তামিলনাড়ুর পাশে পন্ডিচেরিতে। আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় বছরগুলির দুটি তা। দক্ষিণ ভারতের মানুষের ভালোবাসা, আপন করে নেওয়া আমার ভেতরে এক চিরস্থায়ী ছাপ  রেখে গেছে। ফলে তামিলকে দেখে আমার সেই দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাদারহুড জেগে ওঠে। উজ্জ্বল কালো চেহারার ছেলে সে। চেহারা একটু মোটার দিকে কিন্তু শক্তিশালী। আর সহজ সরল তামিল জাতীয়তাবাদী। দক্ষিণ ভারতে এমন মানুষজন দেখে আমি অভ্যস্ত। কিন্তু আমাদের ডিপার্টমেন্টে প্রায় ৩৪ টি দেশের সদস্য রয়েছে। তামিলের টিপিকাল ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ তারা ধরতে পারে না। আমার ডরমিটরি মেট নাইজেরিয়ার মার্টিন এসে বলে যে তামিল কি বলছে তা তার বোঝার বাইরে। আমার মনে পড়ে যায় পন্ডিচেরি প্রথম ক্লাসের স্মৃতি। প্রথমবার ক্লাসে গেছি। পুরুষোত্তমন স্যার পড়িয়ে চলেছেন। আর আমি একটা শব্দও বুঝছি না। আতঙ্কিত হয়ে ভাবছি, এই দেশে দু'বছর থাকব কি করে! 

তামিলের সাথে প্রথমেই বন্ধুত্ব করতে এগিয়ে আসে আমাদের ডিপার্টমেন্টের আফ্রিকার ছাত্রছাত্রীরা। তারা বলিউড দেখে ভারত চেনে। মার্টিন যেমন আমায় ভারতীয় জেনে প্রথম দিনই বলেছিল থ্রি ইডিয়টস এর কথা। তার মতে আমার আচরণ রানছোরদাস শামকদাস চাঁচর ওরফে ফুংসুক ওয়াংরুর মতন। সে বলে " তোমরা ভারতীয়রা এত নিশ্চিন্ত থাকো কি করে?" তার বড় পছন্দ তামিলকে। সে বলে ভারতীয়দের মধ্যে কালো মানুষ আছে তা তার ধারণার বাইরে ছিল।তার মতে "শুধুমাত্র চুলের জন্যই তামিল ভারতীয়। নইলে সে তো ঠিক আফ্রিকান।" তামিল অন্যদিকে নিজেকে তামিল হেরিটেজ এর অংশ বলে জানে। তার তাতে বিশাল গর্ব। আমাদের কোর্সের আর্মেনিয়ার মেয়েটি এসে একদিন বলে "তোমাদের দেশে কি মানুষের নাম, ভাষা আর জায়গার নাম এক?" আমি তাতে হাঁহাঁ করে উঠলে, সে তামিলের উদাহরণ দেয়। নাম তামিল, ভাষা তামিল, জায়গা তামিল। পিয়ুষ যেমন একদিন আমায় জিজ্ঞেস করেছিল তামিল সেলভান নামের মানে। আমি জানাই সেলভান এর অর্থ ছেলে। পিয়ুষ দেখি হকচকিয়ে যায়!  "ওর নাম তাহলে তামিল ছেলে"! আমি নিঃশব্দে মাথা নাড়ি। আমাদের ফ্রেশারস ওয়েলকাম পার্টিতে তামিল তামিলে গান গায়, তার পিছনে জ্বলজ্বল করতে থাকে তামিলনাড়ুর ছবি।

 এই সময়ে শীতের ছুটিতে আমি ঠিক করেছি টেরাকোটা ওয়ারিয়ার্স দেখতে যাব শিয়ান। এমনিতে শিয়ান অবস্থিত সেন্ট্রাল চায়নায়। শীতে এখানে তাপমাত্রা মোটামুটি ৪ডিগ্রির কাছাকাছি থাকে। চীনে শীত এমনিতে ভয়াবহ। বেশিরভাগ জায়গায় মাইনাসে আবহাওয়া। বরফে মুড়ে যায়। একমাত্র কুন্মিং এর দিকটা বাদে। সেখানে আবার পূর্ব চীন থেকে যেতে লেগে যায় প্রায় ৩৮ ঘণ্টা স্লো ট্রেনে। ৩৮ ঘণ্টার টানা জেনারেল কামরায় বসে যাওয়া যে কতটা ভয়াবহ ভেবে সেই প্ল্যান বাতিল করি। হাতে পয়সাও নেই শীতের রাজ্যে যাওয়ার পোশাক কেনার। ফলে দশ দিনের জন্য সিয়ান যাবার পরিকল্পনা করে বসি। আমি মার্টিন, ইমানুয়েল বসে এই নিয়ে কথা বলছি। সকলেই জানে আমি একা ঘুরতে ভালোবাসি। এমতাবস্থায় তামিল ঘরে ঢোকে এবং অন্তত দশবার "আমার এখানে ভালো লাগছে না" "একা ঘরে বসে থাকতে পারছি না" "অন্য কোন ভাল বন্ধু নেই" "চীনদেশ দেখা হবে না" ইত্যাদি বলে আমার সাথে জুড়ে যাবার বায়না করতে থাকে। মার্টিন সে অবস্থায় ইয়ার্কি করে তামিলকে আমাদের কোর্স এরই আমেরিকান ড্রেসডেনকে নিয়ে বালখিল্য মজা করছে। তামিলও ড্রেসডেন ভালো বন্ধু। মার্টিন যেই না বলেছে তাদের প্রেমের সম্ভাবনা নিয়ে, তখনই তামিল গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করে দেয় "ড্রেসডেন আমার মায়ের মত"! গোটা ঘরে নৈঃশব্দ্য। আমি বোঝাই "তামিল, বয়সে বড় কোন মহিলাকে মায়ের মত বলা আদতে কিন্তু তাকে অপমান।" তামিলের তা মাথায় ঢোকে না। "মায়ের মত রেস্পেক্ট করলে বলা যাবে না নাকি!" কি বলব বুঝতে পারছি না আমরা, এই মুহূর্তে তামিল যুদ্ধজয়ীর মতো পকেট থেকে বার করে মোবাইল ফোন। মার্টিন এর দিকে সে ফোনের একটি ছবি ঘুরিয়ে দেখিয়ে বলে "দিস ইজ মাই গার্লফ্রেন্ড, ব্রো। সি হার কালার।" মেয়ের ছবি ধবধবে সাদা। আমি আর মার্টিন মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি এই উজবুক তথা নির্লজ্জের মত রেসিস্ট প্লেজার দেখে। তাও আবার একজন কালো মানুষের মুখে! তামিলের মুখে অবশ্য তখন নির্মম বিজয়ীর হাসি। স্পষ্ট ভাবে সে ঘোষণা করে যে এই সাদা ধবধবে মেয়ে তাকে তিনবার ফেসবুকে 'রিজেক্ট' করেছে। সে চিনে আসায় সাদা ধবধবে তাকে অবশেষে প্রেম করতে রাজি হয়েছে সে জানায়। আমাদের আঁতকে দিয়ে সে এও বলে দেয় কিছুদিনের মধ্যে তার মা যাবে বিয়ের কথা বলতে মেয়ের বাড়ি। মার্টিন যখন বলে " তুমি দেখা না করেই..."! তামিল তার কথা শেষ না হতে দিয়েই উড়িয়ে দেয়। শুধু বলে "ব্রো"।

 সকাল থেকে উশিতে ঘুরছি। তামিলের হাতে বিশাল ব্যাগ। এমতাবস্তায় দেখতে পাই প্রচুর অ্যান্টিক জিনিসের দোকান। তামিল সেখানে খুঁজে পেয়ে যায় বিখ্যাত সুইডিশ ব্র্যান্ডের ঘড়ি। ফুটপাতে বিক্রি হচ্ছে। সে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে " মাত্র ২০০০, ব্রো"। আমার বাঙালি সন্দেহভাজন মন। বলে বসি " ফুটপাতে এসব বিক্রি হচ্ছে তামিল, নকল হলে?" সে আমার দিকে অবজ্ঞায় তাকায়। শুধু বলে " ব্রো"। আমি বুঝে যাই সুইডিশ ঘড়ির ব্যাপারে তামিলের সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে না কোনভাবেই।

কিন্তু মোদ্দা সমস্যা তৈরি হয় রেল স্টেশনে পৌঁছে। চীনের রেলস্টেশনে রাতের শোবার জন্য স্বাভাবিকভাবেই খাট নেই। তামিল তা ঠিক মেনে নিতে পারে না।  সে আমায় বলতে থাকে "ব্রো, শোব কোথায়?" তাকে রেলস্টেশনে রাখা সারসার চেয়ার শোয়ার জন্য ভীষণ আরামদায়ক আর উপযুক্ত বলে খুশি করতে চাই। সে আমায় একেবারেই বিশ্বাস করতে চায় না। রাগত-ভাবে বলে ওঠে 'ব্রো'। আমি দমে যাই। এরপর দেখা যায় তামিল সেলভান এর জেনারেল কামরা এ ঘুমোবার ব্যাপারে ধারণাও অন্যদের থেকে আলাদা। সে যখন জানতে পারে যে জেনারেল কামরায় বসে বসে ঘুমাতে হয় তখন সে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে "ব্রো"। সে ভেবে উঠতে পারেনা সারাদিন উসি তে ঘুরে, ২৪ ঘণ্টা ট্রেনে বসে সে সিয়ান জীবিত অবস্থায় পৌঁছবে কি করে।  সে সিদ্ধান্ত নেয় "ব্রো, এভাবে তো যাওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবু যেহেতু আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি তাই একটু কনসিডার করতে পারি। কিন্তু তার জন্য আমাদের ডরমিটরি ছেড়ে ভালো হোটেলে ঘুমোতে হবে। "আমি তাকে বোঝাই আমার ভ্রমণের দর্শন। তামিল সেসব  এক ফুঁ এ উড়িয়ে বলে দেয় "ব্রো, ডরমিটরি বাতিল"। আমি একটু দূরে গিয়ে চেয়ারে শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করি। তার আগে তামিল কে উইচ্যাট একটা মেসেজ করে তার অপশনগুলো ক্লিয়ার করে দি। তাকে জানাই তার হাতে তিনটে অপশন। আমার সাথে আমার মর্জি মতো ঘোরা, আমায় ভুলে গিয়ে সম্পূর্ণ একা ঘোরা অথবা আলাদা আলাদা জায়গায় থেকে আলাদা মাধ্যমে ভ্রমণ করে একসাথে ঘোরা। এটাও বলে দিই "বন্ধু গেলে বন্ধু পাব কিন্তু বেড়াবার সুযোগ নষ্ট হয়ে গেলে তা আর ফিরবে না, অগত্যা...।" নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি তারপর। সকালে উঠে আমার ট্রেনের টিকিট চাইতে গেলে তামিল বলে যে তা সে কোনমতেই দেবে না। আমি যাতে তাকে ছেড়ে পালাতে না পারি।

সিয়ান ঘোরা হয় এরপর। প্রতিদিন বিকেল ৫ টা বাজলেই তামিল দৌড়য় ডরমিটরির ঘরে। শেষ রাতে যখন আমি ফিরি দেখতে পাই তামিল বিছানায় বসে তামিল ভাষায় তামিলনাড়ুর প্রেমিকার জন্য গান গেয়ে চলেছে। আমি ঢোকামাত্র রুমের বাকি ৪ চৈনিক রুমমেট আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। আমি সেই সবে পাত্তা না দিয়ে তামিলের দিকে ইঙ্গিতে খুব ভালো হচ্ছে বুঝিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। এভাবে দিন দশেক পর ট্রেনে করে আবার ফিরছি। আমার এবং তামিলের অন্য জায়গায় সিট। দেখতে পাচ্ছি সেই গোটা ট্রেনের চৈনিক রা ‘ইন্দুরান ইন্দুরান’ বলে কিছু দেখতে ছুটছে। গিয়ে দেখছি তামিল তখনো তার হেঁড়ে গলায় তামিল প্রেমিকার জন্য তামিল গান গাইছে। আর আমায় দেখে একগাল হেসে বলছে "ব্রো"।


মাজীদ কারিমি

রাত প্রায় ১২:৩০। আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি সুচোউ শহরের দুশু লেকের ধারে। তখন শরতের আগমন হবার সময়। প্যাচপ্যাচে গরম আছে কিন্তু লেকের জলের পাশ থেকে আসা ঠাণ্ডা হাওয়া শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে। আমি একা একা লেকের ধারে বসে হালকা বিয়ার আর সিগারেট খাচ্ছি। চারপাশে মানুষজন খুব কম। চারিদিকে হাওয়া আর অন্ধকার একসাথে গানের মত লাগে। নেশা ধরে যায়। মনে হয় এভাবে এই লেকের ধারে বসে সারারাত কাটিয়ে দেওয়া যায়। আমি গান শুনি কোহেনের। মাঝে মাঝে হেঁটে যাই লেক থেকে পাশে ব্রিজের ধারে। অন্ধকারে সেখানে খানিক বসে থাকি। কাছেই দুশু লেক চার্চের আলো দেখা যায়। ওদিক থেকেও হেঁটে আসি। দেখি রংবেরঙের কাচের ভেতর থেকে আলো ঠিকরে বেরিয়ে যীশু খ্রিষ্টকে রঙিন করে তুলেছে। এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি ফোন আসে আমার বন্ধু মাজীদ কারিমির।

মাজীদ কারিমি ইরানের মানুষ। যদিও ইরান বললে ভুল হবে। তার সাথে প্রথম দেখা হওয়াতেই সে আমায় শুধরে দেয়। " আমি কুর্দিস্তানের লোক। আমার দেশ এই মুহূর্ত অব্ধি ইরানের ভেতরে আছে সত্য। কিন্তু আমি কুর্দিস্তানি।" সে আমাকে জানায় কুর্দিস্তান ও ইরানের সাংস্কৃতিক পার্থক্য। মাজীদ মদ খেতে অত্যন্ত ভালোবাসে। সে বলে কুর্দিস্তানি হিসেবে মদ তার কালচারের অঙ্গ। তাদের দেশের মানুষ নাচে গায় আনন্দ করে। সে বলে ইরানের ইসলামিক রক্ষণশীলতায় তার দমবন্ধ হয়ে আসে। কুর্দিস্তানের সংস্কৃতি ইরান রাস্তার মধ্যে মানুষকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে মৃতপ্রায় করে দিয়েছে। মাজীদকে আমি দেখতে পাই আমাদের ডরমিটরির ঠিক সামনে চীনেদের ছোট ছোট খাবারের দোকানে। আমাদের মাঝে মাঝেই দেখা হয়ে যায়। ছোট ছোট বাইজুর বোতলে চুমুক দিতে দিতে আমি শুনি কুর্দিস্তানের কিসসা। আমাদের প্লেটে একের পর এক খাবার আসতে থাকে। কখনো রাস্তায় তৈরি মশলাদার ঝাল ঝাল নুডুলস। মাজীদের স্পাইসি খাবার বড় প্রিয়। কখনো অক্টোপাস, শুয়োর বা এমনকি আরশোলা কড়া করে ভাজা খেতে খেতে আমি মাজীদের মোবাইল ফোনে শুনেছি কুর্দিস্তানি গান। হিয়ার পত্রিকার জন্য সে সেই গানের অনুবাদ করে দিয়েছে।

মাজীদ এই ডরমিটরির সবচেয়ে বড় মনের মানুষ। প্রত্যেকে জানে বিপদে পড়লে মাজীদ রয়েছে। কারুর টাকার দরকার, মাজীদ কারিমিকে একবারের বেশি দুবার বলার দরকার নেই। রাস্তায় কেউ আটকে পড়েছে, কোন কারণে দূরে কোথাও যেতে হবে মাজীদ কারিমি এক পায়ে খাড়া। প্যানডেমিক এর সময় যখন মানুষজন বিদেশে আটকে পড়েছে, মাজীদ তাদের ঘরের প্রতিটি জিনিস স্যুটকেসে পুরে তাদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। একা। অন্তত দশজনের। আমার মনে পড়ে ক্লাসের বিরতির সময় মাজীদ মাঝেমাঝেই আমায় নিয়ে চলে যেত পাশের খাবার দোকানে। সেখানে তিন বোতল বিয়ার টেনে তবে আমাদের ক্লাসে ফেরা। আমায় সে বানিয়ে খাইয়েছে ইরানের পোলাও। এনে দিয়েছে চায়ের ফ্লেভারওলা মদ। আমার ফোন খারাপ হয়ে যাওয়ায়, সে আমার থেকে বেশি চিন্তিত হয়ে সারাতে থেকেছে। প্রায় ৪ ঘণ্টা ধরে টানা। প্যানডেমিক এ যখন সবাই ঘরের ভেতর লুকিয়ে, সে সুপার মার্কেটে গিয়ে আমাদের সবার জন্য খাবার এনে দিয়েছে। 
মাজীদ আমায় বলেছিল সে আর কখনো ইরান ফেরত যেতে চায়না। "আমায় সে দেশ কিছু দেয়নি। আমায় পরিবার দেয়নি। বন্ধু দেয়নি। আইডেন্টিটি পর্যন্ত দেয়নি", সে মদ খেতে খেতে বলে। মুখ দেখে তার মন বোঝা যায় না।

মাজীদ কারিমি আবার অত্যন্ত আবেগ প্রবণ মানুষ। চীনে আসার প্রথম সপ্তাহেই সে পাকিস্তানের জিলে হুমা মালিকের উপর ভয়ঙ্কর চিৎকার করে বসে। ঘটনা হল হুমা তাদের ডরমিটরি তে গিয়েছিল কিছু খাবার দিতে। সেই ডরমেটরির বাসিন্দা চারজন। ফ্রান্সের ইরানিয়ান বংশোদ্ভূত আফলাতুন, আফগানিস্থানের শফিউল্লাহ, ঘানার ইমানুয়েল আর কুর্দিস্তানি মাজীদ। মোটের উপর ইমানুয়েল বাদে বাকি তিনজন ফার্সিতে কথা বলতে পারে। ইমানুয়েল আমায় বলতো এই ফার্সির ঠেলায় তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছে। সকলে অন্যদেশের মানুষ, অথচ তিনজন এক ভাষা বোঝে আর একজন সম্পূর্ণ ব্রাত্য। যাই হোক, জিলে হুমা তাদের খাবার দিতে গেছে এমতাবস্থায় তার চোখে পড়ে একটা আস্ত মদের বোতল। খাবার টেবিলের উপর রাখা! জিলে হিজাব পরিহিত পাকিস্তানি মহিলা। অত্যন্ত পাঁড় মুসলমান। কুরআন নিয়ে একদম দু বছর টানা মৌলভীর কাছে কোর্স করা মানুষ। তিনজন মুসলমান বাস করে এমন ডরমিটরি তে খাবার টেবিলে মদের বোতল তার সহ্যর সীমানার বাইরে। সে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। "হয় এই মদের বোতল টেবিল থেকে সরবে, নতুবা আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। এই অনাচার মুসলমান হিসেবে সহ্য করতে পারবো না" সে দাবি জানায়। পরদিন শুনি মাজীদ তাকে সরাসরি বেরিয়ে যেতে বলেছে। আমায় সে বলে "বিশ্বাস করো, ঠিক এদের মত মানুষের জন্য আমার দেশের এখন এই হাল, অভিষেক। মদ খেলে সেখানে মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়! রাস্তার মধ্যে ফাঁসিতে লটকে দেওয়া হয়!" 

 দিন যেতে যেতে মাজীদের চরিত্রের কিছু ভয়ঙ্কর দিক সামনে আসতে থাকে। সে অত্যন্ত রাগী মানুষ। শফিউল্লাহ তাকে বারবার রিসার্চ পেপার লিখতে সাহায্য করার কথা বললে, একদিন রেগে সে খাবারের থালা ছুড়ে মারে। আর দেখা যায় তার কাছের মানুষদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতা। সে আমাদের ব্যাচের থাইল্যান্ডের মেয়েটিকে ভালোবাসে, হারাবার ভয়ে কখনো বলে উঠতে পারে না। আমায় মাঝেমাঝেই কথা না হলেই ফোনে মেসেজ করে, "আমাদের বন্ধুত্ব ঠিক আছে তো?" রাশিয়ার ওলগা তার সাথে অকারণে কথা বন্ধ করে দিলে সে বলে "আমি জানি জিলে ওলগার সাথে আমার বন্ধুত্ব নষ্ট করে দিয়ে বদলা নিচ্ছে।" আমি তাকে বোঝাই "মাজীদ, সকলে তোমার বন্ধু নয়"। সে বলে, সে দ্বিচারিতার মুখোশ পরে আছে। বলে "আমি তোমার মতোই একলা থাকতে চাই। পারিনা। এই না পারায় আমার যন্ত্রণা হয়। কারণ আমি আসলে একলা।" আমি মাজীদের পিঠে হাত রাখি।

দুশু লেকে রাতে ঘুরছি, মাজীদের ফোন আসে। সে মদে চুর তখন। আমায় বলে "দিনের পর দিন দেখা করো না। কিসের বন্ধু তুমি?" আমি হেসে ফেলি। তাকে জলের ধারে আসতে বলি। তারপর ঘণ্টা খানেক কেটে যায়। মাজীদ কারিমির দেখা নেই। আমি উঠতে যাব, এমন সময় দেখি সে বাইক নিয়ে আসছে। বাইক ভর্তি মদের বোতল। সম্ভবত আমার সাথে খাবে বলে। দরদর করে ঘামছে সে। তার হাত পা কাঁপছে। সে জানায়, ভুল করে অন্য রাস্তায় চলে গেছিল। আমি শান্ত হতে বলি। সে দেখি হতে পারছে না। আমার সামনে হঠাৎ করে সে মদের বোতলগুলো তুলে রাস্তায় আছাড় মারতে থাকে। আমি শান্ত হয়ে পাশ থেকে চলে যাই। কোন কথা বলি না। রাতে মাজীদের মেসেজ আসে "প্লিজ এই দিনটাকে ভুলে যেও"। আমার ভোলা হয় না। দিনের পর দিন কাটতে থাকে। মাজীদ বহু মাস পর ফোনে লিখে পাঠায়। "তোমার থেকে শিক্ষা পেলাম। খুব কাছের বন্ধুকেও নিজের কালো দিকটা না দেখানোর।" আমার কান্না পায়। মুখে কিছু বলি না। 

প্যানডেমিক এর সময় যখন ভারত বর্ডার সিল করে দিয়েছে মাজীদ আমার ঘরে আসে, বলে "এক ফোঁটা চিন্তা করবেনা। ভারত ঢুকতে না দিলে ইরানে থাকবে। আমার বাড়ি। বছরের পর বছর। "কদিন আগে এসে সে জানিয়ে যায় "টাকা লাগলে দ্বিধা করবে না। ধার  নেবে আমার থেকে। সে ধার কখনো শোধ না করলেও চলবে।"

দুশু লেকের ধারে এখনো যাই বিকেলের দিকে,অবসর পেলেই। ফেরার পথে দেখি আমার বন্ধু মাজীদ কারিমি চীনের ফুটপাতে মদের বোতল আর তার প্রিয় মশলাদার নুডুলস নিয়ে একা বসে বসে খাচ্ছে। পাশে মোবাইলে রিমঝিম করে বাজছে কুর্দিস্তানের সুর।

(চলবে...)


0 Comments



Leave a Reply.

    Archives

    December 2020
    November 2020
    September 2020
    August 2019
    June 2019
    April 2019
    February 2019
    December 2018
    October 2018
    August 2018

Proudly powered by Weebly
  • Home । হোম
  • Blog । ব্লগ
  • Submit | লেখা পাঠাবার নিয়ম
  • Subscribe। গ্রাহক হোন