Agony Opera
  • Home । হোম
  • Blog । ব্লগ
  • Submit | লেখা পাঠাবার নিয়ম
  • Subscribe। গ্রাহক হোন
  • Home । হোম
  • Blog । ব্লগ
  • Submit | লেখা পাঠাবার নিয়ম
  • Subscribe। গ্রাহক হোন
Search

‘মিঞা   কবিতা’ :  প্রেক্ষিত,  নির্বাচন  ও  অনুবাদ   :  একটি   সংক্ষিপ্ত   ইস্তেহার   ।।   অভিষেক   ঝা

26/8/2018

1 Comment

 
Picture
[ এই লেখা ও নির্বাচিত কবিতাগুলি একটি নির্মীয়মান বইয়ের অংশ। এই কারণে খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করা হয়েছে ও ছয়টি কবিতা নেওয়া হয়েছে। ‘মিঞা কবিতার’ সাথে বাংলাভাষী পাঠককে প্রাথমিক পরিচয়টুকু করানোই এই পরিসরের একমাত্র অভিমুখ।]   
‘মিঞা কবিতা’ যেহেতু প্রাথমিক ভাবে একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক মিথোস্ক্রিয়ার ফসল, তাই এই কবিতার প্রেক্ষিত হিসেবে প্রথমেই আমাদের এই কবিতা যে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে জন্ম নিয়েছে তার সম্পর্কে অবহিত হতে হবে।  প্রেক্ষিত আলোচনার জন্য আমাদের ‘মিঞা’ শব্দটি নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে হবে। ‘মিঞা’ অতি পরিচিত একটি বাংলা শব্দ যা জাত হয়েছে বাংলা ভাষার সাথে উর্দু ভাষার আত্মীয়তা সূত্রে। উর্দুতে ‘মিঞা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় পুরুষ লিঙ্গার্থে কোনো সজ্জন ব্যক্তিকে সম্ভাষণ করার সময়, অর্থাৎ ‘মিঞা’র ব্যুৎপত্তিগত আনুষাঙ্গিক ধারণাটি ভদ্রতা, সভ্যতা, সৌজন্য ইত্যাদি গুণাবলী। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ‘মিঞা’ সম্ভাষণটি হিন্দুদের ‘বাবু’ সম্ভাষণের ইসলামীয় সংস্করণ বলে ধরা যেতে পারে যেমন ‘রমেশ বাবু’ ও  ‘গহর মিঞা’। ভাষাগত প্রেক্ষিত থেকে ও সেই ভাষার প্রয়োগ প্রেক্ষিতের দীর্ঘকালীন ইতিহাস থেকে এটি পরিষ্কার যে ‘মিঞা’ শব্দটি কখনই নীচার্থে বা হীনার্থে ব্যবহৃত হয়নি। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের অসম প্রদেশে ‘মিঞা’ শব্দটির কদর্থ করা শুরু হয় ও স্বাধীন ভারতবর্ষের অসম রাজ্যে ‘মিঞা’ শব্দটি গালিগালাজে রূপান্তরিত হয়। কৃষ্টি সূত্রে বাঙালি মুসলিমদের একটি অংশ অসমের প্রায় ২০০০ নদীচরের বিভিন্ন চরে বসবাস করতে শুরু করেন ব্রিটিশ শাসন চলাকালীনই । চা-বাগান অর্থনীতি ও ঔপনিবেশিক শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বলীয়ান বাঙালি বর্ণহিন্দু ও অহমীয়াদের সাথে এদের শ্রেণীগত দূরত্ব বরাবরই স্পষ্ট। এই সময় থেকেই নমশূদ্র ও এদের ‘চরুয়া’ ( চরে বসবাসকারী এবং একই সাথে চুরির মত হীন কাজে অবশ্যই জড়াবেই এই প্রাক-ধারণায় পুষ্ট একটি দোআঁশলা শব্দ) বলে ডাকার রেওয়াজ শুরু হয় এবং ধর্মীয় পরিচয়ে পৃথকীকরণের হেতুই এদের ‘মিঞা’ বলে দেগে দেওয়া হয় যার অনুষঙ্গে জুড়ে থাকে দারিদ্র, অপরিছন্নতা, অসামাজিক কাজকর্ম। দেশভাগের পর অবধারিত ভাবে জুড়ে যায় সংবিধানকে সাক্ষীগোপাল রাখা সেই ট্যাগঃ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী। ভারতের স্বাধীনতার আগে থেকেই অপরীকরণের শিকার হওয়া জনগোষ্ঠী নিজেদের স্বর তৈরির কাজে লেগে পড়ে। বাংলা ভাষা ও কৃষ্টি থেকে দূরত্বজনিত কারণে খুব স্বাভাবিক ভাবে জাত হয় ‘দোরান’ নামক ডায়ালেক্ট যা কামতাপুরী, রাজবংশীয়, অহমিয়া, সিলেটি, বাংলা সব ভাষা থেকেই নিজেকে পুষ্ট করেছে কারণ এই অঞ্চলের যেকোনো জনজাতিই যাবতীয় শারীরিক চূড়ান্ত পরিশ্রমের কাজের জন্য বেছে নিত মিঞাদেরকেই। ফলে মিঞাদের ডায়ালেক্ট এক মিশ্র চরাচর যাকে এখন বাঙালি বলে দাবি করা বাঙালি মৌলবাদের পরিচায়কই হবে।   
 ‘মিঞা’ স্বর তৈরির প্রথম ধাপ ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের এক কবিতাঃ মৌলানা বন্দে আলির ‘এক চরুয়ার শপথ’। গোটা কবিতায় ‘মিঞা’ শব্দটি কোথাও ব্যবহৃত হয়নি, তবু চেনা যায় একটি নতুন ধারা তার খাত খুঁজতে চাইছে, ব্যবহার করছে সেই স্বরের মাটির টান, সেই স্বরের মাটির সুর যেখানে বাঙালি কৃষ্টি অতীত হচ্ছে আর অহমীয়া কৃষ্টি প্রতীয়মান হয়ে উঠছে। সেই বীজ চরের বালিতে পোঁতা থাকল চুয়াল্লিশটা বছর। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে প্রচুর জল বয়ে গেছে। অসম ভেঙেছে , জাতি দাঙ্গায় বারবার রক্তাত্ত হয়েছে এবং বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ইস্যু ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরন ( এন.আর.সি) প্রাসঙ্গিক থেকে প্রাসঙ্গিকতর হয়েছে  অসমের রাজনীতিতে। এবং ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ছয় ঘন্টায় দু’হাজারেরও বেশি বাঙালি কৃষ্টিজাত মুসলমানের গণহত্যার প্রেক্ষিতে ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে কবীর আহমেদ লিখেছিলেন একটি ইংরেজি কবিতাঃ : “ I Beg to State That” যেখানে একটি লাইনে ছিল “ I am a settler, a hated Miya” । এই কবিতাটিই সেই মিঞাত্বের জন্ম দেয় যার ভিতর তুষের মত জ্বলতে থাকে প্রতিবাদী স্বর, এক প্রতি-স্বরের কবিতার ভ্রূণাবস্থা শুরু হয় যার ব্যপ্তি লাভ করতে তখনও বাকি প্রায় তিন দশক। এর ভিতর বহু ঘটনা ঘটবে। রাজীব গান্ধী তীব্র ভাবে এন.আর.সি চাইবেন,  লালকৃষ্ণ আদবাণী রথযাত্রা করবেন, বাবরি মসজিদ ভাঙা হবে, উদার অর্থনীতির ভারতের জন্ম হবে, এন.ডি.এ অসমে এন.আর.সি আবারও চাইবে, নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হবেন, গুজরাটে মুসলিম গণহত্যা হবে, ইউ.পি.এ সরকার থাকাকালীন মমতা ব্যানার্জী অসমের  পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও এন.আর.সি কেন হচ্ছে না বলে চিৎকার জুড়বেন, মমতা ব্যানার্জী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হবেন, নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন, এবং অসমে এন.আর.সির নামে বিশাল সংখ্যক বিভিন্নভাষী জনজাতির মানুষদের আইনী নাগরিকত্ব নিয়ে রাষ্ট্র প্রশ্ন তুলবে---- এই সময়কালে অসমে একটি ব্যাপারেরই কোনো পরিবর্তন হবে না, তা হল, মিঞা সম্ভাষণের মাধ্যমে অসমে বসবাসকারী মুসলিমদের মনুষ্যেতর জীব বোঝাবার চেষ্টা ও হিংস্র ভাবে অপরীকরণ।
     এই সমস্ত প্রেক্ষিতের কবিতা-বিস্ফোরণ হয় ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ শে এপ্রিল যখন বছর পঞ্চাশের একাডেমিক, সমাজকর্মী ও কবি  হাফিজ আহমেদ ইংরেজিতে “Wrie Down I am a Miya” কবিতাটি লিখে ফেলেন, ‘মিঞা কবিতা’র ধারায় এটিই ঘোষিত ভাবে প্রথম মিঞা কবিতা। এই কবিতা দিয়ে হাফিজ আহমেদ ‘মিঞা’ শব্দটির অবমাননাকর কদর্থকে গেরিলা কায়দায় রূপান্তরিত করেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দেশের স্বর হিসেবে। রাষ্ট্র সেই ব্যবস্থা যা ভয় ও বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ও কাজে লাগিয়ে ভয় দেখিয়ে রাজনৈতিক ভাবে শাসন করে, দেশ সেই স্থানাঙ্ক যা  ভৌগলিক ভাবে পালন করে। অসমের মুসলিমরা তাদের দেশ হিসেবে যাকে গড়েছে, সেই অঞ্চলের বাইরে থেকে এসে রাষ্ট্র যখন এন.আর.সি নামক একই সাথে হিংসাত্মক ও ‘জাতীয় আদর্শ’ নামক রাষ্ট্রীয় শাসন-হাতিয়ার ব্যবহার করতে শুরু করে তখন হাফিজ আহমেদের কবিতা সেই অবদমনের বিরুদ্ধে প্রতি- স্বর হয়ে ওঠে । LGBTQA আন্দোলনের শুরুর দিকে যখন ‘Queer’ শব্দটি দিয়ে আন্দোলনকে ব্যঙ্গ করা হত তখন ‘Queer’ শব্দটি নিয়ে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নিয়েছিলেন যে যদি তথাকথিত ‘Straight’রা তাদের ‘Queer’ বলে ব্যঙ্গ করে তাহলে সেই ‘Straight’রা  জেনে রাখুক যে আন্দোলনকারীরা গর্বিত যে তারা ‘Queer’। খেয়াল করুন ‘মিঞা কবিতা’ প্রকরণে ‘মিঞা’ শব্দটি ব্যবহারের রাজনীতিও একই ভাষা রাজনীতি। হাফিজ আহমেদ এই কবিতার ভাষা রাজনীতির দিকটি নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠেন এবং ইংরেজির চেয়েও বেশি জোর দিতে থাকেন অহমীয়া ‘দোরান’ ডায়ালেক্টে কবিতা লেখায়। আহমেদের ধারা অনুসরণ করে যুব সম্প্রদায়ের একটি অংশ ইংরেজিতে ও অহমীয়া ‘দোরান’ ডায়ালেক্টে ‘মিঞা রাজনীতি’র কবিতা লিখতে শুরু করেন যার প্রসার এখনও হয়ে চলেছে। এই ভাষা ‘মিঞা কবিতা’ কে আলাদা রাজনৈতিক প্রেক্ষিত দেয় কারণ বাঙালি কৃষ্টির দোহাই দিয়ে যে অপরীকরণ করা হয়, তার বিরুদ্ধে এই ভাষার ব্যবহার দেখায় অসমের মাটি ও জলকে কতটা আত্মস্থ করলে এই কবিতা ভাষ্যের নির্মাণ করা যায় । সুতরাং এই প্রেক্ষিত থেকে ‘মিঞা কবিতা’ অসমে মুসলিমরা অহমীয়া কৃষ্টির পক্ষে বিপজ্জনক এই তৈরি করা ধর্মীয় রাজনৈতিক ধারণার বিরুদ্ধেও এক প্রতিবাদ বিশেষ।
    ‘মিঞা কবিতা’র বিভিন্ন কবিতা একটু মন দিয়ে পড়লেই কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য চোখে আসে যে বৈশিষ্ট্যগুলি কবিতাগুলিকে একটি বিশেষ স্কুলের কবিতা করে তুলেছে। এন.আর.সি নিয়ে ‘ভয়’ ও ‘আতঙ্ক’ এই দুই মোটিফ  প্রায় সব কবিতায় হয় বারান্দা নয় অন্দরমহল হয়ে রয়েছে। নিজেদের মাটির অধিকার বোঝাবার জন্য কবিতাগুলি শুধুমাত্র তাদের ইতিহাস বিবৃত করতে ব্যস্ত হয়নি, বরং আলগোছে অসমের বিস্তীর্ণ নদীচরের যে নদী-কৃষ্টি তা বারবার ধরেছে বন্যা, ধ্বস, বালুচর, ডুবে যাওয়া রাস্তা, গর্তে পিছলে পড়া এই প্রতীকগুলি ব্যবহার করে।  কবিতাগুলি পড়ার সময় পাঠক হয়ত আবিষ্কার করবেন এগুলি একইসাথে কী করে প্রাকৃতিক , মনোজাগতিক , সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় হয়ে উঠছে। নির্বাচিত কবিতাগুলিতে জবাই করতে চাওয়া পাখি ও পশুর প্রতীকেও সেইভাবে মিঞাদের আর্থ-সামাজিক ভিত্তি ( মুর্গি ও নদী চরের পাঁঠা অন্যতম অর্থনৈতিক ভিত্তি মিঞা সম্প্রদায়ের) ও একই সাথে সেই পশু ও পাখি সত্তায় নিজের সত্তার ত্রস্তভাব দেখতে পাওয়া আমাদের ডেল্যুজ ও গুটারি কথিত ‘Animal  Becoming’ এর কথা মনে পড়ায় যেখানে পশু সত্তা আলাদা কোনো স্তর নয়, বরং এক তীব্র মানুষিক আকুতি। এই আকুতি আবার কোনো এক মেলানকলিক পাখির জন্যও ফিরে আসে এক কবিতায় যে পাখির কাছে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মৃত্যুকে অতিক্রম করে পৌঁছতে চায় মিঞা অস্তিত্ব। যে অস্তিত্ব ডায়েরিয়া, ধ্বস, বুলেট সবকিছুকে অতিক্রম করে বেঁচে থাকতে চায়। তাই তীব্রভাবে নিজ মাটিতে বাঁচতে চাওয়ার ইচ্ছেও এই কবিতাগুলিকে একসাথে নিয়ে এসেছে ‘মিঞা কবিতা’র আকাশে।
        খুবই সংক্ষিপ্ত এই পরিসরে কবিতা নির্বাচনের সময় যে তিনটি দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সেগুলি হলঃ
 ১) যেন ‘মিঞা কবিতা’ রীতির মূল রাজনৈতিক সুরটি উপস্থিত থাকে।
 ২) তিনজন এমন কবিকে বেছে নেওয়া হয়েছে যাদের একজন এই ধারাকে সচেতন ভাবে পুষ্ট করেছে ( হাফিজ আহমেদ), একজন মূলত একাডেমিক মননের কবি যিনি ‘মিঞা’ শব্দটিকে আঞ্চলিকতায় না আটকে রেখে  বিস্তার করতে চেয়েছেন ( সেলিম হুসেন) এবং আপাত ভাবে এই ‘রাজনীতি’ থেকে দূরে থাকা এক কবি যার কবিতা একদম অন্যভাবে রক্তে মিশিয়েছে ‘মিঞা রাজনীতি’কে ( কাজী নীল) । অর্থাৎ ‘মিঞা কবিতা’ ধারার কেন্দ্র, পরিধি ও স্পর্শককে ছুঁতে চেয়েছে এই সংক্ষিপ্ত প্রয়াস।  
৩) প্রকরণ বৈচিত্র্য যাতে বজায় থাকে তার চেষ্টা করা হয়েছে। রাজনৈতিক বিবৃতিমূলক, ব্যঙ্গাত্মক, ও ব্যক্তিগত গীতিধর্মী তিন ধরণের কবিতাই নেওয়া হয়েছে।  
        সবশেষে আসি এই অনুবাদের অভিমুখ ও রাজনীতি প্রসঙ্গে । ‘মিঞা কবিতা’র ডায়ালেক্ট যে নদী অববাহিকার, পশ্চিমবঙ্গে সেই ডায়ালেক্ট ‘ভাগীরথীয়’ ও ‘হুগলীয়’ ( যা কিনা এই সময়ে এসেও হাস্যকর ও কুৎসিত  ভাবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ‘মান্য বাংলা’ হিসেবে চিহ্নিত!) এসেন্স দিয়ে ধরা একেবারেই সম্ভব না। তাই ‘মিঞা কবিতা’র ভাষার নিকটবর্তী ‘তোর্ষীয়’ ও ‘তিস্তানীক’ ও ‘গঙ্গা দিয়ারীয়’ ভাষাতেই আতর পাত্রান্তরের চেষ্টাটুকু করা  হয়েছে, কিন্তু কখনই একমাত্র এই অঞ্চলের ভাষাকেই সবক্ষেত্রেই রেখে দেওয়া হয়নি কারণ সেটা আরেক ধরনের ভাষা মৌলবাদ। তাই একটি মিশ্র ডায়ালেক্টেই অনুবাদ হয়েছে যেখানে ‘মুই’ আর ‘আমি’ , ‘পানি’ আর ‘জল’ দুটিই ব্যবহার করা হয়েছে। যতি চিহ্ন ব্যবহার মূল কবিতা-অনুসারী করা হয়েছে। আসুন, আমরা কবিতা পড়ি।  

হাফিজ আহমেদঃ
লিখে নাও মুই এক মিঞা
লিখো
লিখে নাও
মুই এক মিঞা
এনারছিতে মোর ছিরিয়াল নং 200543 ।
মোর দুই ছেলেপুলে,
সামনের গরমে
আরেকজনা আসিতেছে ।
উয়ারেও ঘেন্না করিবা তো
যেমন হামারে করো?
লিখো
মুই এক মিঞা
হেই বাদাপোড়া পাঁকের জমিকে
মুই সবুজ ক্ষেতি করেচি
তুমাকে খাওয়াতে,
ইটের পর ইট বয়েচি
তুমার বাড়ি বানাইতে,
তুমার গাড়ি চালাইছি
তুমার আরামের লগে,
খানাখন্দ সাফ করেচি
তুমার স্বাস্থ্যের লগে,
তুমার খাটুনির লগে
মুই হাজির যেকোনো সময়।
তবু যদি মন না ভরে
লিখে নাও
মুই এক মিঞা
হেই গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষ, প্রজাতন্ত্রের
অধিকার লগে অধিকার ছাড়া এক নাগরিক।  
হামার মা’কে ডি ভোটার বানায় দিল,  
উয়ার মা বাপ ছিল যদিও ভারতীয়।
ইচ্ছা হইলেই জানে মারি দিতে পারো, লাথ মারি
ভাগাইয়া দিতে পারো হামার গ্রাম হতে,
হামার সবুজ ক্ষেতি কাড়ি নিতে পারো,
বেলন দিয়া বেলি দিতে পারো হামারে,
তুমার গুলি
হামার বুক ফুঁড়ে দিতে পারে,
জানি, তুমার কোনো শাস্তি না হইবে।
লিখো
মুই এক মিঞা
ব্রহ্মপুত্রে বাঁচি আছি
তুমার জ্বালাতন সইতে সইতে,
হামার শরীল কালো হয়া গেছে
চক্ষু আগুনে লাল।

খাড়াও!
রাগ ছাড়া রসদে কিছু নাই।
দূর হটো!
নাইলে
ছাই হয়ি যাও।
[ মূল কবিতা ইংরেজিতে লেখা ]
                      
মুর্গি জবাই চলিছে...
মুর্গি জবাই চলিছেঃ মুর্গি
কসাইয়ের কোনো দোষ নাই,
নাই কোন ভুল।
                       
সমবেদনায় মধু লাগি আছেঃ
একটুক লাগবে না
চোখা ছুরি দিয়া
গর্দানে দু পোঁচ
লাগবে না একটুক।

দু এট্টা মুর্গি কোঁক কোঁকাবে ভাবলেও
কসাইয়ের চোখা ছুরির দিকে চেয়ে
ভাবনাটা মনে গিলে নিল।
দু এট্টা ধড়পড়ানো পালক
জাপটে ধরি
কসাই শুনাচ্ছে সবাইরে
সাবধানবাণীঃ “খবর্দার ভুলবি না তোরা হামার
পোষা মুর্গি
যা মন চায়
তাই করিব
যাকেই মন চায়
তাকেই করিব জবাই ” ।
[ মূল কবিতা অহমীয়া ‘দোরান’এ লেখা]

সালিম হুসেনঃ  

নানা মুইই মিঞাঃ হাফিজ আহমেদের প্রতি           
নানা মুই লিখে লিয়েছি, এটেস্টেড কাউন্টারসাইন কইরে
পাব্লিক নোটারীকে দিয়া ভেরিফাই করি নিয়েছি যে
মুই এক মিঞা
এহন দেখ হামারে
বানের জল থেকি উঠি
ধ্বসের উপর ভাসি
বালুচর, পাঁক আর সাপ মাড়িয়ে আসিতেছি
মাটির অনিচ্ছায় কুড়াল দিয়ে আঁকিছি পরিখা
হামাগুড়ি দিতেছি ধান ক্ষেতির ভিতর দিয়া  
ডাইরিয়া আর আখের ভিতর দিয়া
১০% সাক্ষরতা হারের ভিতর দিয়াও
দেখ হামারে কাঁধ ঝাঁকায়ে কেমনে দুলাইচ্ছি ঝামড়া চুল
পড়ো দু’ডা কবিতা, কষো কিছু অঙ্ক
কেমন ভেবলে আছে দেখ পাষণ্ডরা হামারে বাংলাদেশি বলা কালে
আর আমার ধুকপুকে কলিজাকে বলে দিও
মুই কিন্তু মিঞা।
দেখ মুই হাতে ধরি আছি
সংবিধান
দিল্লীর দিকে আঙুল তুলি আছি
হামার পার্লামেন্ট, হামার সুপ্রিম কোর্ট, হামার কনটপ্লেসের দিকে হাঁটিছি
এমপিদের, মান্যিগণ্যি জাজেদের
আর যে মেয়েটি জনপথে বেচে ঝুটো সোনার গয়না আর তার রূপ
তাদের সবাইরে বলে দিও
হ মুই এক মিঞা।
হামারে দেখতে পাবে কলকাতায়, নাগপুরে, সীমাপুরী বস্তিতেও
হামারে দেখতে পাবে স্যুট পড়ি সিলিকন ভ্যালিতে, ম্যাকডোনাল্ডেও
হামারে দেখতে পাবে মেওয়াটে চালান হয়ে যাওয়া বিয়ার কনেতেও
হামার ছোটোবেলার ছোপগুলি দেখ
দেখ হামার পিএইচডির সার্টিফিকেটের উপর ঝোলা গোল্ড মেডেলগুলি  
তারিপর হামারে সালমা বলি ডাকিও, ডাকিও আমান বলি,
আব্দুল বলি ডাকিও, ডাকিও বাহাতন বলি
কিংবা গোলাম।
হামারে দেখ প্লেন ধরিতে, ভিসা পাইতে, বুলেট ট্রেনে চড়িতে
বুলেট ধরিতে
স্রোতে বইতে
রকেটে চড়িতে
লুঙ্গি পরিয়া মহাকাশে যাইতে
আর অইখানে তোমার চিল্লামিল্লি শুনিবার কেউ নাই,
বাজ পড়ে যেন কোথাও
মুই এক মিঞা।
মুই গর্বিত।
[ মূল কবিতা ইংরেজিতে লেখা ]


রাজ্যের পাঁঠা
রাজ্যের আছে এক পাঁঠা
আগার ঠ্যাং বড়ো পিছের ঠ্যাং ছোটা
পাঁঠার যদি মঙ্গল চাও
ঠেলেঠুলে লিয়ে যাও

রাজ্যের পাঁঠার চামড়া কালো
মোটা তাজা বেশ ভালো
পাঁঠা যদি চুরি যায়
দিতে থাকো আল্লার দোহাই

রাজ্যের পাঁঠার জাত খারাপ
হয় না তা দিয়া ভালো কাবাব
তাও পাঁঠা পড়বে পাতে
নিকট হবে সস্তা মদে

পাঁঠার ছাল কে কিনবে
চুরির মাল কাকে বেচিবে
হাট বাজারে যাইয়া দেখো
জল্লাদ আর দালাল ঢুঁনো

পাঁঠার কোনো উপায় নাই
নরকেও তো ভাই নাই ঠাই
তুমার হাতে গছিয়ে দেই
মুই হালা বেঁচে যাই
[ মূল কবিতা অহমীয়া ‘দোরান’এ লেখা]


কাজী নীলঃ
একটা আধা গ্রাম, আধা শহরের ভিতর দিয়া হাঁটি যাই
একটা আধা গ্রাম আধা শহরের ভিতর দিয়া হাঁটি যাই                                         
মাথার উপর কমদামী আকাশ খুলে নাইছে বৃষ্টির দোকান
আন্ধার সব রাস্তা ছোট ছোট বাড়ির উপরে
একশ বছরের আন্ধার জমে বরফ
বৃষ্টির পানিতে ডুবে বইছে ডোবা-খাল
বৃষ্টিতে আমিও ভিজতেছি ভিতরে বাইরে
আমার মনের ভিতর বৃষ্টির তুলা উড়ে অস্ফূট কাদার মতন

আন্ধারের ভিতর দিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে পিছলায় পড়ি
মৃত্যু শুয়ে থাকে সেই গাড্ডার ভিতর
মৃত্যুর মতন চরম আঘাত লিয়ে উঠি আসি
ল্যাংড়াইতে ল্যাংড়াইতে আমি হাঁটি যাই একটা কমদামী শহরের ভিতর

হাঁটিতে হাঁটিতে মনে পড়ে সেই এক পাখির কথা
যে পাখি দূর কোনো বৃষ্টিহীন শহরে বসে থাকে
ডাল-পাতা ছাড়া গাছের উপর
                               
সেই পাখি মনে পড়লেই আমি ভুলি যাই
আন্ধারের কথা, ল্যাংড়া পা দু’ডার কথা
এই কমদামী আকাশের কথা আমার শৈশব
যন্ত্রণার সেই কালো দিনগুলান যৌবনের
না খাইয়া থাকার কথা ভুলিতে ভুলিতে আমি অন্ধ হই আর
গাড্ডায় পড়ার ডর থাকে না আমার।

সেই পাখিরে আমি কথা দিয়া ফেলেছি
তার লগে আমি গাছের জীবন নিব
ডাল না থাক পাতা না থাক আমি আমৃত্যু ছায়ার
মতন খাড়াইয়ে থাকবো
তার শহরের সব কালো রাত শেষে
আমি আইব সকালের রেলগাড়িতে উশের পাহাড় পার কইরে

সব উপকথায় যেমন যেমন হয়ে থাকে
ঠিক তেমন হইবে না আমার এই যাওয়া
আমি জানি এই আন্ধার এই তুফান এই মৃত্যুময় শীতলতা কিছুই না
আরও এক বিশাল যন্ত্রণার সাগর আমার পাড় হওন লাগে...আরও শক্তিশালী দানবের মতন
ফিচেল শতাব্দী পাড়ি দেওয়া লাগে

তারে আমি কথা দিয়া ফেলেছি
আমি আইব বুকের ভিতর বৃষ্টি ভিজা স্বাদ নিয়া
একটা উপবনের সমস্ত ডাল –পাতা নিয়া
প্রজননকালীন ব্যাঙের ডাক নিয়া আমি আইব
সেই ধূসর শহরের বন্দরে প্রাচীন এক নাবিকের মতন

একটা আধা গ্রাম আধা শহরের মধ্যে দিয়ে হাঁটি যাই
মৃত্যুর মতন যন্ত্রণা নিয়া আমি হাঁটি গেছি
ল্যাংড়াইতে ল্যাংড়াইতে

মাথার উপর কমদামী আকাশ খুলে নাইছে বৃষ্টির দোকান
আমার মনের ভিতর অস্ফূট কাদার মতন বৃষ্টির তুলা উড়ে

মানরী, কদম ফুলের গন্ধ ছড়াইলেই একটা কোকিল ডাকবে
দূর সাগর থিকা উঠি আইব হাওয়া উড়বে লাল উত্তরীয় তোমার
আর
আমি আইব সকালের রেলগাড়িতে…
[ মূল কবিতা অহমীয়া ‘দোরান’এ লেখা]
                        

যদি আর কোনো ভাষা না থাকে দুনিয়ায়
যদি আর কোনো ভাষা না থাকে দুনিয়ায়
যদি হারাইয়া যায় সব অক্ষরমালা
যদি ভাইস্যা যায় খাতা কলম, কবিতার উপমা
যদি কোনো সাংকেতিক ভাষায় আর না কইতে পারি
তোমারে আমার এই নীরব দুখঃ
    
এই মইর‍্যা যাওয়া মন যদি
আর না পায় গানের ঠিকানা
যদি না লিখা হয় চিঠি এই আগুন জ্বলা বসন্তে

যদি বোবা হয়ে যাই, যদি আমাদের চোখ
আর না কয় কোনো কথা
              
যদি নদী থাকে নদীর মতন, ঢেউয়ের কোনো শব্দ নাই
যদি পাখি থাকে গাছের ডালে, ঠোঁটে কোনো বাঁশি নাই

যদি আমরা ছটপট করি সারা রাত  
কথা গুনে উড়ে বেড়ায় শিমূল তুলার মতন
আর বুঝতে না পারি বুকফাটা মেঘের বিষাদ

যদি সব ভাষা হারাইয়ে যায় দুনিয়া থেকে
যদি থেমে যায় এই কলম
ভালবাসার কথা কি আমি কইব না, কও?
আমি কি কইব না এই নীরব দুঃখের কথা
অন্য কোনো আদিম ভাষায়?           
[ মূল কবিতা অহমীয়া ‘দোরান’এ লেখা]
1 Comment
শিবব্রত
13/7/2019 18:03:01

মিঞা ভাষা একটি ডায়ালেক্ট। এটি বাংলা। যেমন ভাবে বাঁকুড়ার বাকরি ভাষা বাংলা , চট্টগ্রামের ভাষা বাংলা, সিলেট এর ভাষা বাংলা। এটা বলা কোনো মৌলবাদ নয়। বরং মিঞা ভাষা বলে এক শ্রেণীর কথ্য ভাষা কে বাংলার থেকে আলাদা করে তাদের জোর করে অসমীয়া পরিচয় চাপিয়ে দেওয়া মৌলবাদ। একশ্রেণীর ভন্ড বুদ্ধিজীবী যারা এতদিন আসামের বাঙালিদের যন্ত্রণাকে একবারও তুলে ধরেনি, এতটাই তাদের বিশ্ববাঙালী হবার আশা , তারাই আজ অসমীয়া জাতিবিদ্বেষীদের হয়ে চুলচেরা বিচার করছে মিঞা ভাষা বাংলা কিনা। এটা অনস্বীকার্য আজকে যদি অসমীয়ারা ব্যাপক দমন পীড়ন না চালাতো এবং কলকাতার উচ্চবর্ণ বুদ্ধিজীবীরা এদের উপেক্ষা না করতো তাহলে এদের আলাদা করে মিঞা ভাষা তৈরি করার চেষ্টা করতে হতোনা। । মিঞা পরিচয়কে মেনে নেওয়াটা একটা নির্মম পরিহাস কারণ এই নিপীড়িত মানুষের কাছে এছাড়া কোনো উপায় নেই , নিজেকে অসমীয়া পরিচয়ের সাথে মিলিয়ে নেবার এক অন্তিম ব্যর্থ চেষ্টা। এযেন আফ্রিকান আমেরিকান দের নিগ্রো বলার সামিল। হú

Reply



Leave a Reply.

    Archives

    February 2021
    December 2020
    November 2020
    September 2020
    August 2019
    June 2019
    April 2019
    February 2019
    December 2018
    October 2018
    August 2018

Proudly powered by Weebly
  • Home । হোম
  • Blog । ব্লগ
  • Submit | লেখা পাঠাবার নিয়ম
  • Subscribe। গ্রাহক হোন