Agony Opera
  • Home । হোম
  • Blog । ব্লগ
  • Submit | লেখা পাঠাবার নিয়ম
  • Subscribe। গ্রাহক হোন
  • Home । হোম
  • Blog । ব্লগ
  • Submit | লেখা পাঠাবার নিয়ম
  • Subscribe। গ্রাহক হোন
Search

জ্বলন্ত   বাড়িতে   কয়েকটা  লোক :   রাজকমল চৌধুরীর ছোটগল্প   ।।  কোনারক   মুখোপাধ্যায়

5/12/2020

1 Comment

 
Picture


​
[রাজকমল চৌধুরী জন্মেছিলেন বিহারের মুরলীগঞ্জের কাছাকাছি রামপুর হাভেলি নামক ছোট্ট একটা গ্রামে। ১৯২৯ সালে। প্রথম লেখালেখির সূত্রপাত মৈথিলী ভাষাতেই। কিন্তু দশটা পাঁচটার চাকরীতে ক্লান্ত রাজকমল যখন ১৯৫৭ সালে আজকের ভাষায় 'ফ্রী লান্স রাইটার/জার্নালিস্ট' হিসেবে কলকাতায় চলে আসেন, তখন ঝোঁক যায় হিন্দিতে সাহিত্যরচনার প্রতি। মাত্র ছ বছর কাটিয়েছিলেন কলকাতায়। কিন্তু হিন্দি লেখালেখির বেশীরভাগই এ সময়ে। এমনকী তার ছোট গল্পের অধিকাংশতেই সমসাময়িক কলকাতা, তার নাগরিক জীবন ও মেট্রোপলিটান বৈচিত্র নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে। মৈথিলী বাদ দিয়ে শুধু হিন্দিতেই লিখেছেন আটটি উপন্যাস, প্রায় একশোটি গল্প ও আড়াইশোর উপরে কবিতা। এছাড়াও লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ, নাটক। গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে বড় হওয়া রাজকমল ধর্মের সহজাত স্ববিরোধ লক্ষ্য করে সব রকম উপাচার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন পরবর্তীকালে আর ষাটের দশকের তথাকথিত 'নিউ আইডিয়াজ' এর প্রতি আকৃষ্ট হন। এমনকী হিন্দি সাহিত্যের যেসব পথিকৃৎ প্রথম সমকামিতার মত তদকালীন স্পর্শকাতর প্রসঙ্গকে সরাসরি স্পর্শ  করেন, রাজকমল তাদের মধ্যে অন্যতম। খুব স্বাভাবিক নিয়মেই হয়তো কলকাতায় রাজকমলের সাথে যোগাযোগ গড়ে ওঠে 'হাংরি জেনারেশন' এর, বা হিন্দিতে যা 'ভুখা পিড়ি' হিসেবে পরিচিত। হাংরি বুলেটিনেও লিখেছেন একসময়। মলয় রায়চৌধুরীর বিতর্কিত 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটির হিন্দি অনুবাদক তিনিই। 
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রাজকমল চৌধুরীর উল্লেখ নেই। এমনকী হিন্দি সাহিত্যের সার্বিক চিত্রেও তিনি যেন বেশ খানিকটা ব্রাত্যই। নীচের লেখনীটি তাঁর ‘জ্বলতে হুয়ে মকানমে কুছ লোগ’ নামক হিন্দি ছোট গল্পের সরাসরি বঙ্গানুবাদ। সম্ভবত বাংলায় তাঁর অনুবাদ এই প্রথমবার। ]
​

 
এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বাড়িটা বেশ্যাবাড়ি। মন্দির নয়। ধর্মশালাও নয়। শমশাদ বলেছিল - কোনো অসুবিধা হবে না। শোবার জন্য পরিষ্কার কাচা বিছানা পেয়ে যাবে। সকালে ওখানেই স্নান-টান সেরে, চা-জলখাবার খেয়ে চলে আসবে। আমি বলেছিলাম - বেশ। একজন সেলসম্যানের এর চেয়ে বেশি আর কী বা চাই! রাতে মাথা গোঁজবার একটু জায়গা। একটা ঘর। যে কোনো একটা মেয়েছেলে। আর শেষমেশ, ঘুম।

মেয়েটা খারাপ ছিল না। কিন্তু, অবস্থা এক্কেবারে লজঝড়ে ছিল। বলেছিল - ওড়ানোর মতো ক’টা টাকা হাতে থাকলে দিশি রামের বোতল আনাও। সারা দিন এই শিল্প-নগরীতে ঘুরে ঘুরে আমি হাজার পাঁচেক টাকার বিজনেস করে ফেলেছিলাম। আমার কমিশন তিনশো টাকার কাছাকাছি দাঁড়ায়। রামের বোতল আনানোই যেতো। রামের বড়ো বোতল আর সামনের পাঞ্জাবী হোটেল থেকে মুরগির শোরবা। মেয়েটার ফুর্তি আর ধরছিল না। আমার গলা জড়িয়ে ধরে নেচে উঠেছিলো মেয়েটা। বলেছিল - তুমি গুরু দিলদার লোক আছো। রাত হোক আর একটু, তোমায় আমি খুশি করে দেবো। বাকি রেন্ডিদের মতো ঠাণ্ডা লাশ নই আমি। একবার গরম হয়ে গেলে না, তুমিই হয়রান হয়ে যাবে...।

এ বাড়িতে মেয়েছেলে আরো ছিল। তবে শমশাদ আমায় বলে দিয়েছিল - অন্য কারো কাছে যেও না যেন। দীপু ওর নাম, দীপু। পাঞ্জাবের মেয়ে। ওর কাছেই যেও। আমিও দীপুর কাছে চলে এসেছিলাম। বলেছিলাম - শমশাদ তোমার কাছে পাঠিয়েছে। আমি ন্যুবিল্ট কোম্পানির সেলসম্যান। কাল সকালে কলকাতা চলে যাব। রাতটুকু থাকতে চাই। তবে, টাকা-পয়সা খুব বেশি নেই আমার কাছে।

কোন শমশাদ? কাশ্মীরী হোটেলের শমশাদ? তো সে নিজে এলো না কেন? আচ্ছা, অ্যাংলো পাড়ার ওই কেলেকুষ্টি মেমটার ঘরে গিয়ে উঠেছে তো? হাঁ, এখন তো ওর ঘরেই যায় - দীপু একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে উত্তর দিয়েছিলো, তারপর আমার থেকে পাওয়া বিশ টাকা বাড়ির মালিককে দিতে চলে গিয়েছিলো। পরে ফিরে এসে ও বলেছিল - ওড়ানোর মতো ক’টা টাকা হাতে থাকলে দিশি রামের বোতল আনাও। আট টাকায় হয়ে যাবে। মদ আর মেয়েছেলে এখানে সস্তায় জুটে যায়। এই দেখো না, এই একটা রাত ধান্দায় বসলে গোটা পঞ্চাশেক টাকা তো লোকে হেসে খেলেই দিয়ে দেয়। আমার বাপু আলসেমি নেই। কাজও গুছিয়ে করতে জানি। তুমি একটুও লজ্জা পেও না। ভেবে নাও, অন্ধকারে সব মেয়েছেলে সব পুরুষ মানুষের বউ হয়। অন্ধকারে কোনো লজ্জা থাকে না। রঙ, ধর্ম, জাতপাত, শত্রুমিত্র, প্রেম-ভালোবাসা, আস্থা-বিশ্বাস - অন্ধকারে কিচ্ছু থাকে না। শুধু কোমরের নিচে চড়ে বসা মেয়েটা মনে থেকে যায়।

রাত তখন হয়তো বারোটাও বাজেনি, হঠাৎ পুলিশের রেইড! বাড়ির সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। মালিক হয়তো জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছে যে পুলিশ আসছে, সে তাড়াতাড়ি দীপুর ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। বলল - দীপু, পুলিশ এসছে। ক্লায়েন্টকে নিয়ে পালা! বলেই সে দীপুর মতো বাকি যে সব মেয়েদের ঘরে ক্লায়েন্ট ছিল, তাদের দরজায় দরজায় যেতে লাগলো। ক্লায়েন্টকে নিয়ে পালা। কিন্তু কোথায়? দীপু বলল - নিচে, আণ্ডারগ্রাউণ্ডে। চলো, ওখানেই বাকি বোতল মারা যাবে, আর বাকি যা যা করার সে সবও। আরে ঘাবড়িও না, পুলিশ বেশিক্ষণ থাকে না। দীপুর গায়ে একরত্তিও কাপড় নেই, আমারও অবস্থা প্রায় তথৈবচ। দীপু একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল - চলো চলো, গেলাস-বোতল সব তোলো! তাড়াতাড়ি!

চারিদিক ঘন অন্ধকারের চাদরে ঢাকা, আর ঠাণ্ডা সিমেন্টের মেঝেয় আমরা আলোর অপেক্ষায় বসে। কখন আসবে আলো? দীপু শরীর থেকে চাদরটা খুলে নিয়ে ঠাণ্ডা মেঝেয় বিছিয়ে দেয়। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দেওয়াল খুঁজে বোতল-গ্লাস সব কোণের দিকে রেখে দেয়। তারপর জিজ্ঞেস করে - আর কে কে এসছে এখানে? চন্দ্রাবতী এসছিস নাকি? ঘন অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যায় না। নিজের হাত-পা পর্যন্ত না। আর এই অন্ধকারের মধ্যে দীপুর স্বর রূপোর তলোয়ারের মতো চকচক করতে থাকে - উত্তর দিচ্ছিস না কেন? এখান থেকে আওয়াজ উপরে যায় না। আর এতোক্ষণে তো মালিক পুলিশকে মালকড়িও খাইয়ে দিয়েছে নিশ্চয়ই। আর ভয় নেই। কথা বলছিস না কেন? কে আছিস এখানে?

কে? দীপু রানি নাকি? তুইও এসছিস? ক্লায়েন্ট কেমন তোর? বোতল নিয়ে এয়েছে? এট্টু দু’ঢোক আমায়ও দে না ভাই। কী ঠাণ্ডা এখানে! কি রে, দিবি তো? - দ্বিতীয় নারীকন্ঠ অন্ধকারের পর্দা চিরে প্রকট হয়। আমার খালি মনে হতে থাকে ঘরের মধ্যে ছায়ামূর্তিরা প্রেতের মতো ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে। ঘরে পায়চারী করতে থাকা একজন লোক আমার পায়ে হোঁচট খায়। ঘাবড়ে গিয়ে সে লাফিয়ে ওঠে - বাপরে! আমি ভাবলাম কোনো জন্তু জানোয়ার হবে!

হাঁ, জানোয়ারই তো! আপনি মশাই নিজেকে কী ভাবছিলেন? মানুষ? জনাব, এ পাড়ায় তো শুধু জন্তু জানোয়ারই আসে। মানুষ তো আসে না! আপনি কে মশাই? - দীপু খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। ঘরে পায়চারী করতে থাকা লোকটা সিগারেট ধরানোর জন্য দেশলাই জ্বালায়। লোকটার গায়ে একটা ওভারকোট। মাথায় হ্যাট নেই। পায়ে জুতো নেই। নাকের নিচে ঘন মোটা গোঁফ। সারা শরীর থেকে দেবদূতসুলভ ভাব গড়িয়ে পড়ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম - আপনি?

আমি ইঞ্জিনিয়র। এখানেই একটা ফ্যাক্টরিতে কাজ করি। ব্যাচেলার মানুষ, সময় কাটাব বলে এখানে এসেছিলাম। তখন কি ছাই জানতাম, সে সময় এই কালকুঠরিতে কাটবে - লোকটা আবার দেশলাই জ্বালায়, আর ঘরের বাকি অস্থায়ী অধিবাসীদের জরিপ করতে থাকে। ছোট্ট ঘর। নগ্ন দেওয়াল, নোনাধরা। মেঝে আর্দ্র, ভেজাভেজা। নিজের দু’হাতে মাথা গুঁজে একটা রোগাভোগা মেয়ে এক কোণে বসে আছে। সবুজ লুঙ্গি আর সাদা ফতুয়া পরা একটা বুড়ো ঘরের মাঝামাঝি জড়োসড়ো হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চন্দ্রাবতী খুব বাচ্চা-বাচ্চা দেখতে একটা ছেলের কোলে মাথা রেখে মেঝেয় শুয়ে আছে। ছেলেটাকে দেখে মনে হয় কলেজ স্টুডেন্ট। সে চন্দ্রাবতীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দেশলাই কাঠি নিবে যায়। ইঞ্জিনিয়র ফের পায়চারী করতে শুরু করে। তার ভারী জুতোর মচমচ অন্ধকারে ভেসে বেড়াতে থাকে। ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বুড়ো বলে ওঠে - আমার সব পয়সা জলে গেল। আমার মেয়েছেলেটাও উপরে রয়ে গেল। আমার কাছে একটু মদও নেই। একটা সিগারেট পর্যন্ত নেই। কে জানে পুলিশ কতক্ষণ উপরে এর’ম হল্লা করতে থাকবে।

সত্যিই, উপরে যেন আগুন লেগেছে। ছাদ যেন ভেঙ্গে পড়বে যে কোনো মুহূর্তে। পুলিশ বোধহয় সব ঘরে ঘরে তল্লাশি নিচ্ছে। হয়তো, উপরে যে মেয়েরা রয়ে গিয়েছে, তাদের চড়-থাপ্পড়ও লাগাচ্ছে। বাড়ির মালিককে চাবকাচ্ছে হয়তো। কিছুই বোঝার উপায় নেই। শুধু, মনে হচ্ছে, উপরে কারা সব দৌড়াদৌড়ি করছে, আর খুব শোরগোল হচ্ছে।

কলেজ স্টুডেন্টের মতো দেখতে অল্পবয়সী ছেলেটা খুব মিহি গলায় চেঁচিয়ে ওঠে - দেশলাই! দেশলাই জ্বালাও। ...আমার প্যান্টে কী একটা পোকা ঢুকেছে! দেশলাই জ্বালাও...। কিন্তু কেউ দেশলাই জ্বালে না। ইঞ্জিনিয়র নির্লিপ্তভাবে পায়চারী করতে থাকে। দীপু আমার গায়ের কাছে সরে আসে। দেওয়াল ধরে ধরে ও মদের বোতল আর গ্লাস খোঁজে। গ্লাস ভেঙ্গে যায়। অসাবধান হাতের সামান্য ঠোক্করেই গ্লাস ভেঙ্গে যায়। আমি মেঝেয় হাতড়ে হাতড়ে কাচের বড়ো বড়ো টুকরোগুলো কোণের দিকে সরিয়ে দিতে থাকি। ভাঙ্গা কাচের টুকরোর আওয়াজে খুব মিষ্টি একটা সুর আছে। দীপু বোতল থেকেই সরাসরি দু’ঢোঁক মদ গলায় ঢেলে নেয়, তারপর বোতল আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কাশতে শুরু করে। পুরনো শুকনো কাশি। হয়তো শ্বাসকষ্ট আছে ওর। চন্দ্রাবতী বলে ওঠে - একা একা খেলে এই হয়…

দেব রে হারামজাদী! তোকেও দেব। তর সয় না মাগির - দীপু খিঁচিয়ে ওঠে, তারপর আবার কাশতে থাকে। আমি ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া পা দু’টো সোজা করার চেষ্টা করি। পা ছড়াতেই ডান পায়ের আঙুলে রাবারের কিছু একটা জিনিস আটকে যায়। পা টেনে এনে আমি জিনিসটা আঙুল থেকে ছাড়িয়ে হাতে নিই। এই নারকীয় কালকুঠুরির মধ্যেও রাবারের তৈরি এ জিনিসটা নিয়ে আসতে লোকে ভোলেনি। এই নিকষ অন্ধকারেও ভোলেনি। আমার ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি আসে। তারপর আমি বোতল থেকে গলায় রাম ঢালার চেষ্টা করি। কে জানে, আর কতটুকু মদ পড়ে আছে। চন্দ্রাবতী অন্ধকারে হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড়  করে এগিয়ে আসে, আর হাসতে হাসতে আমার কোলে লুটিয়ে পড়ে। দীপু অন্ধকারেও বুঝেছে যে এটা চন্দ্রাবতীই। বলে - দেখ চন্দ্রা, মাল খাবি, তো এই বাবুকে খুশিও করতে হবে। এ বাবুও আমাদেরই জাত। আমরা গায়ের চামড়া বেচি, বাবু চামড়া দিয়ে বানানো খেলাধুলোর জিনিসপত্তর বেচে…

হে ভগবান! তুমি তো এক্কেবারে উদোম - চন্দ্রাবতী খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। আমিও মজা পেয়ে ওর হাতে বোতল ধরিয়ে দিই। ও মজা পেয়ে দীপুর হাতে বোতল ধরিয়ে দেয়। বোতল খালি হয়ে যায়, আর আমার মাথা ঘুরতে শুরু করে। রাবারের ওই জিনিসটা এখনো আমার আঙুলে ধরা। আমার মাথা ঘোরে। কি একটা বিষম দুর্গন্ধে নাক জ্বলে যেতে থাকে। কিসের দুর্গন্ধ এটা? মনে হয় ধারেকাছে কোথাও কোনো ইঁদুর মরে পড়ে আছে। চন্দ্রাবতী যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে এমন পাতলা, এমন অকিঞ্চিৎকর হয়ে গেছে। আমি ওর ব্লাউজের মধ্যে হাত ঢোকাই। ভেতরে কিচ্ছু নেই। শুধু ঝুলতে থাকা এক টুকরো মাংস। অথচ, ওর দুই উরু দিয়ে কী দৃঢ়ভাবেই না আঁকড়ে রেখেছে আমাকে! আমি ঘেন্নায় ছটফটিয়ে দূরে সরে যেতে চাই। কিন্তু যেতে পারি না। আমার দুই পা ওর দু’উরুর মধ্যে বন্দী।  কী মোটা উরু! কী ভারী কোমর! দীপু বলে - এ মাগির কাছে খালি মিলিটারি ক্যাম্পের ওরা ছাড়া কেউ আসে না। হারামজাদী ছেলেদের কাঁচা খেয়ে নেয়। কী, সেলসম্যান সাহেব, কেমন বুঝছ?

আমি কুঁকড়ে যেতে থাকি। চন্দ্রাবতী জোর লাগায়, আমি কুঁকড়ে যেতে থাকি। মনে হয় আমার দু’পায়ের ফাঁকে কোনো মরা ইঁদুর চেপ্টে রয়েছে। মদ খেয়ে আমার শরীর আরো ঠাণ্ডা হয়ে উঠতে থাকে। ঠিক তখনই ঘরের মাঝখানে দাঁড়ানো বুড়োটা চিৎকার জুড়ে দেয় - সাপ! সাপে খেলো রে আমায়! ওরে বাবা! আলো জ্বালো… সাপে কামড়েছে রে আমায়, আলো দাও কেউ… আলো…

আলো জ্বলে না। ইঞ্জিনিয়রের ভারী জুতোর শব্দ থেমে যায়। কিন্তু দেশলাই জ্বলে না। চন্দ্রাবতীর সঙ্গে আসা ছেলেটা ভয়জড়ানো গলায় কাতরায় - দেশলাই জ্বালাও! ইঞ্জিনিয়রবাবু দেশলাই জ্বালাও। আমায় সাপে কামড়াবে… আমি একবার একটা সাপ মেরেছিলাম। সাপ সব মনে রাখে, নির্ঘাত বদলা নেবে… আমায় বাঁচাও। প্লিজ আমায় বাঁচাও…

ইঞ্জিনিয়র পাত্তাও দেয় না। বলে - আমার দু’টো সিগারেট রয়েছে, দেশলাই কাঠিও ঠিক দু’টোই পড়ে আছে, যখন আবার সিগারেট খেতে ইচ্ছে হবে, তখনই দেশলাই জ্বালব।

অন্ধকারে ইঞ্জিনিয়রের সিগারেটের লাল শিখা দপদপ করে। সেই পলকা আলোয় তার পুরুষ্টু গোঁফ চকচক করে। এক কোণে দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। চন্দ্রাবতী বলে - মরতে দাও বুড়োকে। শালা ঘাটে যাওয়ার বয়স হয়ে গেছে, এখানে খাটে চড়ে মজা কত্তে এসছে। দীপু বলে - ও রবারের সাপ হবে। গতবারে যখন পুলিশ রেইড হ’ল, ওই আট নম্বরের সুলতানা সঙ্গে করে রবারের সাপ নিয়ে এসছিল। আমাদের খুব ভয় দেখিয়েছিল মাগি। সুলতানার ক্লায়েন্টটা তো ভয়ে এক্কেবারে ভিরমিই খেয়ে গেলো। 

রবারের সাপ না, আসল সাপ! পা দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে আমার। বিষ চড়ছে… মাথায় চড়ছে। বিষধর সাপ। সবাইকে কামড়াবে। সব্বাইকে কামড়াবে বলে দিলাম - বুড়ো চেঁচাতে থাকে, আর মেঝেয় পড়ে হাত-পা ছুঁড়তে থাকে। দীপু হেসে গড়িয়ে যায় - শালা ভয়ে কেমন ছটফটাচ্ছে দ্যাখো… আরে দাদু, তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে, এখন যদি মরোও, তাতে কী এসে যাবে… কী বে চন্দ্রী, হতভাগী করছিস কী? তাড়াতাড়ি খালাস কর বাবুকে। বেচারা আট টাকার মাল আনিয়েছে, কড়কড়ে বিশ টাকা ক্যাশ দিয়েছে, চিকেন কষা তো উপরেই পড়ে রইল… বেচারিকে একটু মজা তো করতে দে। দু’টো কসরত আমিও দেখাই। তাড়াতাড়ি সার চন্দ্রী, দেখ আমি কির’ম গরম হয়ে যাচ্ছি।

এতক্ষণে ইঞ্জিনিয়র দেশলাই জ্বেলে দ্বিতীয় সিগারেট ধরায়। বুড়োর পায়ে গ্লাসের ভাঙা কাচ ঢুকে গেছে। সত্যিই রক্ত বেরোচ্ছে। বুড়ো মেঝেয় পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে চেঁচায় - আমি কয়লার স্টকিস্ট। আমি মরলে লোকে আমার গুদাম ভেঙে সব কয়লা তুলে নিয়ে যাবে… ছেলেটাও হয়েছে পয়লা নম্বরের বেকুব। ঘর-দোর জমি-জমা সব বেচেবুচে রেন্ডিদের পিছনে ঢেলে দেবে গো… আমায় বাঁচাও… আমায় বাইরে যেতে দাও। এই কালকুঠুরি থেকে আমায় বের করো...।

কলেজ স্টুডেন্টের মতো দেখতে ছেলেটা দেশলাইয়ের আলোয় একা বসে থাকা মেয়েটাকে দেখতে পায়। সে একটু একটু করে মেয়েটার দিকে সরে আসতে থাকে। মেয়েটা ভয়ে গুটিসুটি মেরে চুপচাপ বসে আছে। ছেলেটা হয়তো, চন্দ্রাবতীর অভাব পূরণ করতে চায়। ইঞ্জিনিয়র দেশলাই নিভিয়ে দেয়, আর ফুসফুসের সমস্ত শক্তি দিয়ে সিগারেটে টান মারতে থাকে। দীপু দু’পায়ের ফাঁকে মদের খালি বোতল চেপে রেখেছে। কাঠের গুঁড়ির মতো মোটা মোটা তার থাই। চন্দ্রাবতী নিজের দু’হাতে আমার ঘাড় চেপে ধরে, আমাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে - এ মিস্টার, তুমিও তো কিছু করো… শুধু আমি একাই করব? একটু জোর তো লাগাও।

কিন্তু আমার মনে হয়, আমি এবার অজ্ঞান হয়ে যাব। এই দমবন্ধকর অবস্থা, এই হিমশীতল মেঝে, ইঞ্জিনিয়রের সিগারেটের ধোঁওয়া, মরা ইঁদুরের দুর্গন্ধ, বুড়ো লোকটার চিল চিৎকার, দীপুর উরুর ফাঁকে আটকে থাকা বোতল… আমার মনে হয় আমি এবার অজ্ঞান হয়ে যাব। হঠাৎ বোতল ছুঁড়ে ফেলে দীপু খেঁকিয়ে ওঠে - অ্যাই চন্দ্রী, ফোট এবার তুই, সর এখান থেকে। আমি দেখাচ্ছি এবার বাবুকে… চল, সাইড হ’, শালাকে কাঁচা খেয়ে নেব আমি…

রামের খালি বোতল দেওয়ালের কোণে বসা ওই মেয়েটার গায়ে গিয়ে পড়ে। খুব পাতলা খনখনে গলায় সে আর্তনাদ করে ওঠে - মরে গেলাম। মাথা ফেটে গেলো গো আমার… মরে গেলাম রে।

অল্পবয়সী ছেলেটা শিকারি কুকুরের মতো এক লাফে মেয়েটার কাছে চলে যায়। ইঞ্জিনিয়র আবার ঘরে পায়চারী শুরু করে। ওর ভারী জুতোর আওয়াজ বড়ো ভয়ানক। চন্দ্রাবতী মেঝেয় পড়ে হাঁপাচ্ছে। দীপু আমার উপর চড়ে বসেছে, আর আমায় ঝাঁকাচ্ছে। আমি আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ি। হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাই। হয়তো মরে যাই। মরে যাওয়া ছাড়া, এখন আর অন্য কোনো উপায়ও নেই।
 
 

​
1 Comment
Ujjal Banerjee
7/12/2020 09:05:58

ভালো ,অসাধারণ

Reply



Leave a Reply.

    Archives

    April 2021
    February 2021
    December 2020
    November 2020
    September 2020
    August 2019
    June 2019
    April 2019
    February 2019
    December 2018
    October 2018
    August 2018

Proudly powered by Weebly
  • Home । হোম
  • Blog । ব্লগ
  • Submit | লেখা পাঠাবার নিয়ম
  • Subscribe। গ্রাহক হোন